বৈদ্যুতিক গাড়ির জগতে ঢুকছে বাংলাদেশও
বিশ্বজুড়েই বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের জোয়ার উঠেছে। জাগুয়ারসহ বিশ্বের বড় বড় গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি এরই মধ্যে বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বাজারে আনার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকবে কেন? আধুনিক প্রযুক্তির বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির জগতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কার্বন নিঃসরণ কমাতে ব্যাটারি তথা বিদ্যুচ্চালিত গাড়ি বাজারে আনার কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। আসছে বছর দেশের রাস্তায় দেখা মিলবে বৈদ্যুতিক গাড়ি।
বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে কারখানাটি তৈরি হচ্ছে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে। এটি এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল। ৩০ হাজার একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত অর্থনৈতিক অঞ্চলে ইলেকট্রিক গাড়ি প্রস্তুত করতে ১০০ একর জায়গা পেয়েছে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে কারখানার কাজ। তবে করোনার ধাক্কায় মাঝখানে কিছু সময় গতি কমেছে কাজে। চীন, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইতালিকে অংশীদার করে আগামী বছরের শুরুতেই দেশের বাজারে বৈদ্যুতিক গাড়ি আনতে চায় বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ।
স্কুল–কলেজের শিক্ষক, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কথা মাথায় রেখেই চার চাকার গাড়ি উৎপাদন করা হবে। মূলত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্তকে টার্গেট করতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। গাড়ির দাম থাকবে ৭ থেকে ১৪ লাখ টাকার মধ্যে। কিস্তিতে থাকবে টাকা পরিশোধের সুযোগ। মহাসড়কে ব্যাটারিতে চার্জ দেওয়ার জন্য দেশে বিদ্যমান সিএনজি ও পেট্রলপাম্পের পাশে বসানো হবে চার্জিং ইউনিট। বাসায়ও ব্যাটারি চার্জ দেওয়া যাবে।
দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের চিন্তা কখন এল জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজের চেয়ারম্যান এ মান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে গাড়ি উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তি কী আসছে, তা দেখার জন্য ২০১৬ সালে প্রথমে চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশ ভ্রমণ করি। ওই সব দেশ ভ্রমণে গিয়ে দেখেছি, পরিবহনে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বড় বড় গাড়ি প্রস্তুতকারক কোম্পানি। সেখান থেকেই দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের পরিকল্পনা শুরু করেছিলাম।
বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা আছে কি না, তা যাচাই করতে দেশজুড়ে একটি জরিপ করে অটো ইন্ডাস্ট্রিজ। তাতে দেখা গেছে, জেলা, উপজেলা পর্যায়ে একজন শিক্ষকের বেতন–ভাতাসহ অন্যান্য আয় মিলে মাসিক বেতন ৩০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। আবার গত এক দশকে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন–ভাতাও বেড়েছে। ফলে স্থানীয় প্রশাসনে যাঁরা কর্মরত, তাঁদের আয়ও ভালো। এর পাশাপাশি রাজনীতিবিদদের হাতেও টাকা আছে। তাঁদের অনেকে এখন মোটরসাইকেল চালায়। এমন বেশ কয়েকটি পেশার ওপর জরিপটি চালিয়ে দেখা গেছে, দেশের বাজারে চার চাকার বৈদ্যুতিক গাড়ি বাজারজাত করে যেকোনো কোম্পানি সফল হতে পারবে। তা ছাড়া দেশে চাহিদাও দিন দিন বাড়ছে। তাতে বাজারের আকারও বড় হচ্ছে। বিদেশ থেকে গ্রামে প্রচুর টাকা ঢুকছে। মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত শ্রেণি চাইলে চার চাকার ব্যাটারিচালিত গাড়ি ব্যবহার করতে পারে। এসব দিক বিবেচনা করে দেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ।
ব্যাটারিচালিত গাড়ি উৎপাদনে প্রথমেই দরকার জমি। বড় আকারে জমি পেতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সঙ্গে যোগাযোগ করে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রথমে বেজা থেকে মৌলভীবাজারের শ্রীহট্ট অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কাঁচামাল আমদানি করতে হবে, সে জন্য বন্দরের পাশে জমির নিশ্চয়তা চেয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। শেষ পর্যন্ত চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১০০ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয় তাদের। বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ বলছে, কারখানায় গাড়ি সংযোজন নয়, সরাসরি উৎপাদন করা হবে। গাড়ির ৭০ শতাংশই কারখানায় উৎপাদিত হবে, বাকি ৩০ শতাংশ হবে সংযোজন।
বৈদ্যুতিক গাড়ি হবে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ডের। গাড়িগুলোর নকশা এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে, যাতে খুব সহজে এ দেশে ব্যবহার করা যায়। বিদ্যমান জাপানি ও কোরিয়ান গাড়ির নকশা যেভাবে করা, সেভাবেই এ দেশে গাড়ির নকশা করা হচ্ছে। নকশা তৈরির ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের কথাও মাথায় রাখা হয়। যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে গাড়ি ব্যবহার করা যায়। পাঁচ সিটের হ্যাচব্যাক কার মডেলের দাম পড়বে ৭ থেকে ১০ লাখ টাকার মধ্যে। যে কেউ দেড় লাখ টাকা এককালীন জমা দিয়ে গাড়ি নিতে পারবেন। ৭ থেকে ১০ হাজার টাকা কিস্তিতে বাকি টাকা পরিশোধ করার সুযোগ থাকবে।
পাঁচ সিটের সেডান গাড়ির দাম পড়বে ১৩ থেকে ১৪ লাখ টাকা। এখানেও এককালীন টাকা জমা দিয়ে বাকি টাকা কিস্তিতে জমা দেওয়ার সুযোগ থাকবে। কারখানায় শুধু চার চাকার বৈদ্যুতিক গাড়িই নয়, একই সঙ্গে মাইক্রোবাস, কাভার্ড ভ্যান ও মিনি ট্রাক উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে।
জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে বাংলাদেশ অটো ইন্ডাস্ট্রিজ মোট তিনটি কারখানা করবে। একটি কারখানায় তৈরি হবে গাড়ির বডি, দ্বিতীয় কারখানায় তৈরি হবে ব্যাটারি এবং তৃতীয় কারখানায় তৈরি হবে মোটর কন্ট্রোলার চার্জার।
জানা গেছে, কারখানায় মোট তিন ধাপে বিনিয়োগ করা হবে। প্রথম কারখানা নির্মাণ ও কাঁচামাল আমদানিতে ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ ৮৫০ কোটি টাকা। দ্বিতীয় ধাপে বিনিয়োগ হবে ৩০ কোটি ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। মান্নান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বৈদ্যুতিক গাড়ি উৎপাদনে আমরা বেশ আশাবাদী। আশা করছি, ভালো সাড়া পাব।’ আগামী বছরই বাংলাদেশ বৈদ্যুতিক গাড়ির যুগে প্রবেশ করবে বলে জানান তিনি।