এক বছর আগের সব রেকর্ড ভেঙে কাঁচা পাটের মণপ্রতি দাম সাত হাজার টাকা ছুঁয়েছিল। তা নিয়ে পাটকলমালিকেরা সোচ্চার হলে ধীরে ধীরে দাম কমে। গত জুলাইয়ে শুরু হওয়া চলতি মৌসুমে কাঁচা পাটের দাম ছিল আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা মণ। দুই মাস না যেতেই আবার অস্থিরতা শুরু হয়। ডিসেম্বরে এসে কাঁচা পাটের দাম গিয়ে ঠেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকায়।
কাঁচা পাটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এবারও বিপাকে পড়েছেন পাটকলমালিকেরা। তাঁরা বলছেন, ‘দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই পূর্ণ উৎপাদনক্ষমতায় কারখানা চালাচ্ছেন না। কেউ কেউ উৎপাদন বন্ধ রেখেছেন। কাঁচা পাট নিয়ে গতবারের অরাজকতার জন্য অনেক বিদেশি ক্রেতা হারিয়েছি। চলতি বছরও সেটির পুনরাবৃত্তি হলে পাটকলগুলো রুগ্ণ শিল্পে পরিণত হবে।
মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে পাটকলমালিকদের দুই সংগঠন বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিজেএমএ) এবং বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) নেতারা গত সপ্তাহে বৈঠক করেছেন। বৈঠকে তাঁরা গতকাল থেকে প্রতি মণ উচ্চ মানের পাট সর্বোচ্চ ৩ হাজার ২০০ টাকা ও নিম্ন মানের পাট ২ হাজার ৭০০ টাকায় কেনার সিদ্ধান্ত নেন। কাঁচা পাটের অবৈধ মজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর ব্যবস্থা না নিলে আগামী ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পাটকলগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
পাট অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ৯০ লাখ ৯১ হাজার বেল কাঁচা পাট উৎপাদিত হয়েছে। তার আগের বছর পাট উৎপাদিত হয়েছিল ৮৪ লাখ ৫৫ হাজার বেল। বিজেএমএ ও বিজেএসএ জানায়, বেসরকারি পাটকলগুলোর জন্য বছরে ৬০ লাখ বেল কাঁচা পাট প্রয়োজন। আর গৃহস্থালিতে ব্যবহারের জন্য দরকার পাঁচ লাখ বেল। সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ থাকায় দেড় বছর ধরে সার্বিকভাবে কাঁচা পাটের অভ্যন্তরীণ চাহিদা কিছুটা কমেছে।
পাট অধিদপ্তরের দেওয়া কাঁচা পাট উৎপাদনের তথ্য যদি সঠিক হয়, তাহলে কেন দাম বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে বিজেএসএর পরিচালক মো. জাহিদ মিয়া বলেন, লাইসেন্স না থাকলে কাঁচা পাটের ব্যবসা করা যায় না। কিন্তু পাট ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্ত নন, এমন মানুষজনও অতিমুনাফার লোভে কাঁচা পাট কিনে মজুত করেছেন। পাট অধিদপ্তর আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কাঁচা পাটের অবৈধ মজুতদারি বন্ধ হতো। অধিদপ্তর অভিযান পরিচালনা করলেও সেটি অনেকটাই কাগজে-কলমে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানির ৬০ শতাংশই হচ্ছে পাটের সুতা, যা দিয়ে কার্পেট তৈরি করা হয়। একাধিক পাটকলমালিক প্রথম আলোকে জানান, কাঁচা পাটের দাম অত্যধিক বেড়ে যাওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা ঝুট কাপড়, তুলা ও পিপি সুতার দিকে ঝুঁকছেন। তাই কাঁচা পাটের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে পাটের সুতার বিকল্প পণ্যগুলোই স্থায়ীভাবে জায়গা দখল করবে।
কাঁচা পাটের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে বহুমুখী পাটপণ্য রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বিপদে পড়েছে। ক্রিয়েশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাশেদুল করিম বলেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় ব্যবসাও ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। তবে কাঁচা পাটের দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায় ভয়াবহ সমস্যা হচ্ছে। গতবার মুনাফা করা যায়নি। তিনি আরও বলেন, এবারে দেশে পাটের ভালো ফলন হয়েছে। মণপ্রতি উৎপাদন খরচ পড়েছে দুই হাজার টাকার মতো। তারপরও দাম কেন সাড়ে তিন হাজারে যাবে?
বর্তমানে বিজেএমএর সদস্যসংখ্যা ২০৮। এর মধ্যে ৭০টি বন্ধ। আর বিজেএসএর ৯৬ সদস্য কারখানার মধ্যে সচল আছে ৬০টি। উৎপাদনে থাকা কারখানাগুলোয় কাজ করেন আড়াই লাখ শ্রমিক।
বিজেএমএর চেয়ারম্যান আবুল হোসেন গতকাল বলেন, ‘কাঁচা পাটের দামে অস্থিরতার কারণে আমাদের সংগঠনের ৫০ শতাংশ সদস্য কারখানার উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। গতবারের আকাশচুম্বী দামের কারণে ইতিমধ্যে আমরা ব্যবসা হারাতে শুরু করেছি। পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমেছে সাড়ে ১১ শতাংশ। আমাদের প্রত্যাশা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো সোনালি আঁশের পতন ঠেকাতে যথাযথ উদ্যোগ নেবে।’