ইলিশ যাবে ইউরোপ–আমেরিকা
মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাজারে ইলিশ মাছ রপ্তানির অনুমোদন চেয়ে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চার মাসে ২৬টি প্রতিষ্ঠান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে। এ জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স থাকা বাধ্যতামূলক হলেও তা আছে ১২ প্রতিষ্ঠানের, বাকি ১৪ প্রতিষ্ঠানের নেই।
জানা গেছে, আবেদনকারীদের প্রায় সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা জড়িত। তেমনই একজন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ইসহাক আলী খান ওরফে পান্না, যিনি বর্তমানে খান ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী। তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির কাছে ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন চেয়ে গত মাসে আবেদন করেছেন। এতে তিনি নিজেকে ‘দীর্ঘদিন ধরে হিমায়িত মাছ রপ্তানির সঙ্গে সম্পৃক্ত’ বলে উল্লেখ করেন।
ইসহাক আলী আবেদনে জানান, স্থানীয় চাহিদার অতিরিক্ত ইলিশ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করাই তাঁর উদ্দেশ্য। তাঁর আবেদনপত্রে বাণিজ্যমন্ত্রী সুপারিশ করেছেন।
রপ্তানির জন্য ২৬ আবেদন , কাউকে কাউকে অনুমতি দিতে দুই মন্ত্রীর সুপারিশ, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানেরই বাধ্যতামূলক সনদগুলো নেই।
আওয়ামী লীগের বরিশাল মহানগরের সাবেক শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও বরিশাল জেলা মৎস্য সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নিরব হোসেন ওরফে টুটুল গত মাসে এক হাজার টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন চেয়ে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন বরাবর আবেদন করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মাহিমা এন্টারপ্রাইজ’। তিনিও ভারত, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ইলিশ রপ্তানি করতে চান। তাঁর আবেদনপত্রে সুপারিশ করেছেন তথ্য প্রতিমন্ত্রী মো. মোরাদ হাসান।
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, রপ্তানির অনুমোদন শেষ পর্যন্ত দেওয়া হবে কি না, তা এখন পুরোপুরি নির্ভর করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ওপর। সাধারণত দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইলিশ ভারত পর্যন্ত যায়। তা-ও পূজা-পার্বণ উপলক্ষেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি করে বাংলাদেশ। তবে পুরো ভারতে নয়, পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায়। এ ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতেও (ইউএই) কিছু ইলিশ রপ্তানি হয়।
এবার ইলিশ কি এখন ইউরোপ, আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও যাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে বছর বছর ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে বলে সমস্যা নেই। এতে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আয় হবে—এমন আশার কথাই বলছেন তাঁরা।
এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবেদনগুলো অনুমোদন করা যায় কি না, সে জন্য আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছি
গত রোববার মুঠোফোনে বারবার চেষ্টা করেও বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশির সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা সম্ভব হয়নি। তবে বাণিজ্যসচিব মো. জাফর উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আবেদনগুলো অনুমোদন করা যায় কি না, সে জন্য আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। এ ব্যাপারে মৎস্য অধিদপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছি।’
মৎস্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন ইলিশ ধরা পড়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন।
ইলিশ রপ্তানির জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্স নেওয়া ১২ প্রতিষ্ঠান হচ্ছে: ঢাকার ওয়ারীর অর্পিতা ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও উত্তরার কাশফি সি ফুড; চট্টগ্রামের মাসুদ ফিশ প্রসেসিং অ্যান্ড আইস কমপ্লেক্স, আনরাজ ফিশ প্রোডাক্টস ইন্ডাস্ট্রিজ ও আর্ক সি ফুডস; খুলনার আছিয়া সি ফুডস, ছবি ফিশ প্রসেসিং ইন্ডাস্ট্রিজ, মডার্ন সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ ও ব্রাইট সি ফুডস; বাগেরহাটের ফকিরহাটের বাগেরহাট সি ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ; বরিশালের মাহিমা এন্টারপ্রাইজ এবং পটুয়াখালীর নিরালা সি ফুডস।
বেশির ভাগেরই সব সনদ নেই
মৎস্য রপ্তানি করতে হলে মৎস্য অধিদপ্তরের লাইসেন্সের সঙ্গে ট্রেড লাইসেন্স; আয়কর, ভ্যাট ও ইআরসি সনদ এবং বিক্রয় চুক্তি ইত্যাদি থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ইলিশ রপ্তানির অনুমতি চেয়ে আবেদন করা ২৬ প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই সব সনদ নেই। খান ইন্টারন্যাশনাল, ঢাকার ইউনিয়ন ভেঞ্চার ও নুবাইদ করপোরেশন এবং চট্টগ্রামের নিহাও ফুড কোম্পানি ও গ্রিন ওয়ার্ল্ড ইমপেক্স তো আবেদনপত্র ছাড়া কোনো কাগজপত্রই জমা দেয়নি।
যখন আবেদন করেছিলাম, ৫ হাজার টন রপ্তানির বাস্তবতা ছিল। এখন সরকার কত পরিমাণ রপ্তানির অনুমোদন দেয়, তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা প্রস্তুত।
আংশিক কাগজপত্র থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে: ঢাকার নিজাম এন্টারপ্রাইজ, খুলনার জাহানাবাদ সি ফুডস, চট্টগ্রামের প্যাসিফিক সি ফুডস, বাগেরহাটের রূপসা ফিশ অ্যানআড এলাইড এবং বাংলাদেশি মালিকানাধীন সি মিলেনিয়াম ট্রেড (এম) এসডিএস, বিএইচডি মালয়েশিয়া।
ইলিশ রপ্তানির জন্য আবেদনকারী অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পিবিএ ইন্টারন্যাশনাল, আরাবি ইন্টারন্যাশনাল, এ এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল এবং ইউটেক সিস্টেমস লিমিটেড।
কে কী বলেছে
আবেদনকারী ২৬টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৭টি ১ হাজার টন করে ইলিশ রপ্তানি করতে চায়। তবে ইউটেক সিস্টেমস নামের প্রতিষ্ঠান একাই রপ্তানি করতে চায় ৫ হাজার টন। নিহাও ফুড কোম্পানি দেড় হাজার, প্যাসিফিক সি ফুডস ৯০০, সি মিলিনিয়াম ট্রেড ও আরাবি ইন্টারন্যাশনাল ৫০০ টন করে রপ্তানি করতে চায়। এর বাইরে এ এইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ২০০ এবং জাহানাবাদ সি ফুডস ১৫০ টন ইলিশ রপ্তানি করতে আগ্রহী।
বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান আবেদনপত্রে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে ইলিশ রপ্তানির কথা বলেছে। এর মধ্যে আরাবি ইন্টারন্যাশনাল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ৫০০ টন রপ্তানি করতে চায়। তাদের ক্রয়াদেশ দিয়েছে ত্রিপুরার আমদানিকারক সিদ্ধেশ্বরী এন্টারপ্রাইজ। এ এইচ ইন্টারন্যাশনালও ভারতেই রপ্তানি করবে বলে জানিয়েছে।
ইউটেক সিস্টেমস আবেদনপত্রে রপ্তানি গন্তব্যস্থল হিসেবে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাম উল্লেখ করেছে। সি মিলেনিয়াম ট্রেড নিয়ে যাবে মালয়েশিয়ায়।
সর্বোচ্চ ৫ হাজার টন রপ্তানির জন্য আবেদনকারী ইউটেক সিস্টেমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারিকুল ইসলাম গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আবেদন করেছিলাম, ৫ হাজার টন রপ্তানির বাস্তবতা ছিল। এখন সরকার কত পরিমাণ রপ্তানির অনুমোদন দেয়, তা বলা যাচ্ছে না। তবে আমরা প্রস্তুত।’