সমুদ্রপথে রাসায়নিক রপ্তানিতে পদে পদে বাধা
রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে ভারত ছাড়া আরও ১৩ দেশে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানির যে বাজার তৈরি হয়েছিল, তা হাতছাড়া হওয়ার পথে।
বড় শিপিং কোম্পানিগুলো এখনো পরিবহন শুরু করেনি।
একটি ছাড়া কোনো ডিপো এ রাসায়নিক নিচ্ছে না।
রপ্তানি আদেশ নিয়ে বসে আছেন রপ্তানিকারকেরা। চাহিদামতো রপ্তানি হচ্ছে না।
হাতছাড়া হওয়ার পথে ৬৯ শতাংশ বাজার
হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানির আদেশ নিয়ে বসে আছেন রপ্তানিকারকেরা। স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে এ পণ্যটি রপ্তানি হলেও সমুদ্রপথে এই পণ্য পরিবহনে রাজি হচ্ছে না বড় শিপিং কোম্পানিগুলো। এতে ভারত ছাড়া আরও ১৩ দেশে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানির যে বাজার তৈরি হয়েছিল, তা হাতছাড়া হওয়ার পথে। ডলার–সংকটের এ সময়ে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি নিয়ে চার মাস ধরে ভোগান্তিতে রয়েছেন পণ্যটির রপ্তানিকারকেরা।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে গত ৪ জুন ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর সমুদ্রপথে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি বন্ধ হয়ে যায়। এ ঘটনার পর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় শিপিং কোম্পানি ও রপ্তানিকারকদের নিয়ে বৈঠক করে। সে সময় আন্তর্জাতিক বিধিবিধান মেনে রাসায়নিকটির ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন রপ্তানিকারকেরা।
বর্তমানে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে নিয়মিত রপ্তানি হচ্ছে এই পণ্য। স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানির ক্ষেত্রে কনটেইনারে পণ্য পরিবহন ও ব্যবস্থাপনা করতে হয় না বলে সেখানে সমস্যা হচ্ছে না। তবে সমুদ্রপথে রপ্তানিতে কনটেইনার দরকার। কিন্তু বড় শিপিং কোম্পানিগুলো কনটেইনারে এ পণ্য পরিবহনে এগিয়ে আসছে না। যদিও ছোট শিপিং কোম্পানিগুলো কিছু পণ্য রপ্তানি করছে।
তবে ছোট শিপিং কোম্পানিগুলোর সব দেশে পণ্য পরিবহনসেবা নেই। সে জন্য বড় শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন শুরু না করলে বাধা কাটবে না বলে জানিয়েছেন রপ্তানিকারকেরা।
এদিকে চট্টগ্রামের ১৯টি ডিপোর মধ্যে সিসিটিসিএল ডিপো এই পণ্য ব্যবস্থাপনা করছে। অন্য ডিপোগুলো এই রাসায়নিকের ব্যবস্থাপনা করছে না। তাতে একটি ডিপো দিয়ে রপ্তানি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
রপ্তানির তথ্যে দেখা যায়, চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে ৬৫ লাখ মার্কিন ডলারের ১৮ হাজার টন হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড রপ্তানি হয়। এর মধ্যে সমুদ্রবন্দর দিয়ে গেছে ১২ লাখ ৩৭ হাজার ডলারের ২ হাজার ৬৮৮ টন পণ্য। আর এ সময়ে স্থলবন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৫২ লাখ ডলারের সমমূল্যের প্রায় ১৬ হাজার টন হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড।
বাংলাদেশে তৈরি এই রাসায়নিকের রপ্তানির বাজার রয়েছে বিশ্বের ১৪ দেশে। গত অর্থবছরে এই খাতে রপ্তানি আয় হয় ২ কোটি ৮১ লাখ ডলার। রপ্তানির ৩১ শতাংশই গেছে ভারতে। বাকি ৬৯ শতাংশ গেছে পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, কেনিয়াসহ ১৩ দেশে।
রপ্তানিতে শীর্ষ দুটি প্রতিষ্ঠান হলো সামুদা কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড ও মেঘনা গ্রুপের তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। গত অর্থবছরের মোট রপ্তানির ৮২ শতাংশ আয় এসেছে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের হাত ধরে।
তাসনিম কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মনিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের হাতে প্রায় ২০ লাখ ডলারের রপ্তানি আদেশ রয়েছে। ঋণপত্রের নিশ্চয়তাও নেওয়া হয়েছে। রপ্তানি করতে না পারলে এখন অগ্রিম নেওয়া ডলার ফেরত দিতে হবে। ডিপোগুলো এই পণ্য নেওয়ার কথা বললেও বাস্তবে নিচ্ছে না।
চট্টগ্রামের আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্সও রপ্তানির চেষ্টা করছে। শ্রীলঙ্কায় এক কনটেইনারের একটি চালান রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। আর পাকিস্তানে রপ্তানির জন্য পাঁচ কনটেইনার ডিপোতে বোঝাই হয়েছে।
আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স চট্টগ্রামের স্মার্ট গ্রুপের। গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক ক্যাপ্টেন মঈনুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, সব মিলিয়ে ১০২ কনটেইনার রপ্তানির আদেশ আমাদের হাতে রয়েছে। এর মধ্যে মাত্র পাঁচটি কনটেইনারে রপ্তানির ব্যবস্থা হয়েছে। বড় শিপিং কোম্পানিগুলো পরিবহন করতে রাজি না হওয়ায় সমুদ্রপথে রপ্তানি করা যাচ্ছে না।
এ ছাড়া এস আলম গ্রুপের ইনফিনিয়া কেমিক্যাল কমপ্লেক্স, ঢাকার এইচপি কেমিক্যালস লিমিটেড কারখানা ও এম এইচ ক্যামিকেল নামে একটি প্রতিষ্ঠান এই পণ্য রপ্তানি করে।
একাধিক রপ্তানিকারক জানান, কারখানা থেকে এই রাসায়নিক গাড়ি করে প্রথমে ডিপোগুলোতে নেওয়া হয়। সেখানে কনটেইনারে বোঝাই করে বন্দর দিয়ে তুলে দেওয়া হয় জাহাজে।
ডিপোগুলো কেন এই রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা করতে চাইছে না তা জানতে চাইলে কনেটইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নুরুল কাইয়ূম খান প্রথম আলোকে বলেন, বিএম ডিপোতে দুর্ঘটনার পর শুরুতে কেউ রাসায়নিক নিতে চায়নি। এখন একটি ডিপো নিচ্ছে। আর যেসব ডিপোর রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার আলাদা ব্যবস্থা রয়েছে, তাদের এ পণ্য নিতে সমস্যা থাকার কথা নয়। আশা করি, এ সংকট দ্রুত কেটে যাবে।
বড় কয়েকটি শিপিং লাইনের কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিএম ডিপোতে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডবাহী কনটেইনার দুর্ঘটনার কারণে এ পণ্য পরিবহনের আগে তাঁরা ভালোভাবে যাচাই–বাছাই করছেন।
হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের বেশি ব্যবহৃত হয় টেক্সটাইল শিল্পে। এ ছাড়া খাদ্যপণ্য ও ওষুধশিল্পে এই রাসায়নিকের ব্যবহার হয়। টেক্সটাইল শিল্পের শতভাগ চাহিদা মেটাচ্ছে দেশীয় কারখানাগুলো। শুধু ফুড গ্রেড ও মেডিকেল গ্রেডের হাইড্রোজেন পার–অক্সাইড আমদানি হচ্ছে।
রপ্তানিকারকেরা জানান, হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডের বৈশ্বিক বাজার প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের। শীর্ষ রপ্তানিকারক বেলজিয়াম। বৈশ্বিক বাজারের প্রায় ৩ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে রয়েছে। এই রাসায়নিক রপ্তানিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা করছে মূলত সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে।