গ্যাস–সংকটে কমছে কারখানার উৎপাদন, সক্ষমতার ৬০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে না

গ্যাসপ্রতীকী ছবি

রাজধানী ঢাকার পাশের শিল্প এলাকা গাজীপুরের শ্রীপুরে আউটপিস স্পিনিং মিলস কারখানায় সুতা উৎপাদন হয়। এক মাস ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে এই কারখানা। উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশই এখন ব্যবহার করতে পারছে না কারখানাটি। ফলে ক্রেতাদের সুতা সরবরাহ করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন আউটপিস স্পিনিংয়ের মালিক।

পরিস্থিতি নিয়ে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রাজীব হায়দার বেশ হতাশ। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ক্রয়াদেশ মোটামুটি ভালো থাকলেও গ্যাস-সংকটের কারণে পণ্য সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। সময়মতো সরবরাহ দিতে না পারলে মুশকিলে পড়তে হবে। তিনি আরও বলেন, উৎপাদন কমে যাওয়ায় তাঁর উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। ফলে কোম্পানির নগদ অর্থের প্রবাহ কমেছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়া নিয়ে তাই চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে হচ্ছে।

সমস্যা শুধু শ্রীপুরের এই কারখানার একার নয়। আউটপিস স্পিনিং মিলসের মতো অনেক বস্ত্রকলই এক মাসেরও বেশি সময় ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর নেতারা বলছেন, গ্যাস-সংকটে দেশের ৭০-৮০ শতাংশ বস্ত্রকলের উৎপাদন গড়ে ৪০ শতাংশে নেমেছে। এতে তৈরি পোশাক কারখানায় সময়মতো কাঁচামাল পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে পোশাক রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং এর ফলাফল দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্যের আয়ে দেখা যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিটিএমএ নেতারা।

বস্ত্র খাতের মতোই তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে সিরামিক শিল্পও। এটি আরেকটি খাত, যেখানে বড় পরিমাণে গ্যাসের ব্যবহার হয়। সিরামিক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিসিএমইএর নেতারা বলছেন, তীব্র গ্যাস-সংকটে ২২-২৫টি সিরামিক কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। কারখানাগুলোয় গ্যাস চাপ যেখানে ১৫ পিএসআই (পাউন্ডস পার স্কয়ার ইঞ্চি) প্রয়োজন হয়, সেখানে গ্যাসের চাপ ২-৩ পিএসআই থেকে শুরু করে কোথাও কোথাও শূন্যে নেমে এসেছে। ফলে এসব কারখানায় প্রতিদিন ২০ কোটি টাকার উৎপাদন ক্ষতি হচ্ছে।

শিল্পোদ্যোক্তারা অভিযোগ করছেন যে গ্যাস-সংকটের কারণে তাঁদের এখন লোকসান গুনতে হচ্ছে। আগের তুলনায় অতিরিক্ত দাম দিয়েও কারখানাগুলো গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাচ্ছে না। গত বছরের জানুয়ারিতে সরকার গ্যাসের দাম গড়ে ৮০ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়, যা ছিল দেশের ইতিহাসে একসঙ্গে সর্বোচ্চ মূল্যবৃদ্ধির ঘটনা। তখন কোনো কোনো শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছিল ১৭৯ শতাংশ পর্যন্ত। মূল্যবৃদ্ধির আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে সরকারিভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে দাম বেশি পড়লেও গ্যাসের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।

নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের প্রতিশ্রুতিতে গ্যাসের জন্য বাড়তি দাম দিতে উদ্যোক্তারা রাজি হলেও দেশে গ্যাসের সংকট কখনোই কাটেনি। পরিস্থিতি বরং এখন আরও খারাপ হওয়ার কারণে বিপাকে রয়েছে অনেক শিল্প। উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলার সময় অনেকের কণ্ঠে ক্ষোভেরও আভাস পাওয়া গেল।

লিটল স্টার স্পিনিং মিলের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাসের সংকট রয়েছে। তারপরও মে মাসের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত সক্ষমতার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারতাম। তবে এখন সংকট চরম আকার ধারণ করেছে। সক্ষমতার ব্যবহার এখন কমে ৪০ শতাংশে নেমেছে। এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতায় অবস্থিত তাঁর এই সুতার কারখানায় দিনের বেলায় উৎপাদন সক্ষমতার ৩০-৩৫ শতাংশ এবং রাতে ৪০ শতাংশ ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে। মিলটিতে প্রতি মাসে ১ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে।

সংকটের বিস্তার

গ্যাস-সংকটের সমাধান চেয়ে গত মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) চেয়ারম্যান জনেন্দ্রনাথ সরকারকে চিঠি দেয় বিটিএমএ। চিঠিতে সংগঠনটি বলে, গত বছরের জানুয়ারি থেকে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ১৬ টাকা থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে ৩১ টাকা ৫০ পয়সা করা হয়েছে। এ সময় সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়, শিল্পকারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা হবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এক বছরের বেশি সময় ধরে কারখানাগুলো বাড়তি বিল দিলেও গ্যাসের সরবরাহ কখনোই কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

জানতে চাইলে বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, গাজীপুরের টঙ্গী, জয়দেবপুর, শ্রীপুর ও ভালুকা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, পলাশ, মাধবদী ও মদনপুর এবং সাভার ও আশুলিয়ায় গ্যাস-সংকট তীব্র। দেশের বস্ত্রকলগুলোর ৭০-৮০ শতাংশই এসব এলাকায় গড়ে উঠেছে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ ১-২ পিএসআইয়ে নেমে যায়। রাতে কোনোরকমে উৎপাদন চালানো যায়। তাতে উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে রীতিমতো বিপদে আছেন বস্ত্রকলমালিকেরা।

বস্ত্রকলের উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল পোশাক কারখানাগুলো। বস্ত্রকল থেকে সুতা এনে কাপড় বুনে ডাইং করা হয়। তারপর সেই কাঁচামাল থেকে পোশাক তৈরি হয়। তবে গ্যাস-সংকটে বস্ত্রকলগুলো কাঁচামাল সরবরাহ করতে পারছে না বলে নিশ্চিত করেছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। পাশাপাশি গ্যাসের সংকটে তাঁরাও ভুগছেন।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঈদের আগে গ্যাসের চাপ ছিল শূন্য। ঈদের পর গ্যাসের চাপ ৩-৪ পিএসআই পাচ্ছি। এতে সব মেশিন চালানো যাচ্ছে না। গ্যাস-সংকটের কারণে সুতা ও কাপড় ডাইংয়ের কাজ ব্যাহত হওয়ায় কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় আসছে না। এতে প্রতিটি ক্রয়াদেশের বিপরীতে সরবরাহ ১৫-২০ দিন বিলম্বিত হচ্ছে। ডাইং কারখানাগুলোর উৎপাদনক্ষমতা ৫০ শতাংশ কমেছে।’

মোহাম্মদ হাতেম জানান, গ্যাস-সংকটের মধ্যে পোশাক তৈরির কারখানার বয়লার চালাতে তাঁরা আগে সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস আনতেন। তবে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করেছে। তিনি বলেন, ‘তিতাস একদিকে গ্যাস দিতে পারছে না। অন্যদিকে তারা সিএনজি স্টেশন থেকে সামান্য গ্যাস আনতেও বাধা দিচ্ছে। তারা কি চায় শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাক?’

গ্যাস-সংকটের সমাধান চেয়ে গত সপ্তাহে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিসিএমইএ)। সেই চিঠিতে সংগঠনের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা উল্লেখ করেন, সিরামিক কারখানার চুল্লি চালাতে ২৪ ঘণ্টা গ্যাসের সরবরাহ থাকতে হয়। গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই ছাড়া চুল্লির ভেতরে উৎপাদনপ্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। গ্যাসের চাপ কমে গেলে চুল্লির ভেতরে থাকা সব পণ্য নষ্ট হয়ে যায়। আর একবার চুল্লি বন্ধ হলে চালু করতে সর্বনিম্ন ৪৮ ঘণ্টা সময় লাগে।

চিঠিতে সিরাজুল ইসলাম মোল্লা সতর্ক করে বলেন, গ্যাস-সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান রুগ্‌ণ হয়ে পড়লে ব্যাংকঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হবে।

কেন এই সংকট

দেশে গ্যাসের সংকট নতুন কোনো বিষয় নয়। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই গ্যাস-সংকটে ভুগছে শিল্প খাত। এই সংকট দেখিয়েই সরকার গ্যাস আমদানির পথে হেঁটেছিল। ২০১৮ সালের শেষ দিকে দেশে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজি আমদানি শুরু হয়। কিন্তু ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বেড়ে যায়। একপর্যায়ে সরকার চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে গ্যাস কেনা বন্ধ করে দেয়। এখন অবশ্য এলএনজির দাম অনেক কমে গেছে।

গ্যাসের স্থানীয় উৎপাদন না বাড়ায় গ্যাস খাত এরই মধ্যে বিদেশনির্ভর হয়ে পড়েছে। এলএনজি আমদানি করে তা গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে একটি টার্মিনাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়েছে।

জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, একটি টার্মিনাল বন্ধ থাকায় গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। এটি জুলাইয়ের মাঝামাঝি চালু হতে পারে।