ময়দা, চিনি, তেলের মূল্যবৃদ্ধি বাড়িয়েছে বিস্কুটের দাম
রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম পরিবারের জন্য নিয়মিত বিস্কুট কেনেন। তাঁর হিসাবে গত এক বছরের মধ্যে বিস্কুটের ছোট ও মাঝারি প্যাকেটের দাম ৫ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তিনি বলেন, শুধু যে দাম বেড়েছে তা নয়, অনেক প্যাকেটে বিস্কুটের পরিমাণও কমেছে।
বিস্কুট তৈরির কাঁচামালগুলোর মধ্যে রয়েছে ময়দা, চিনি, ভোজ্যতেল, বনস্পতি তেল (ডালডা), ডিম, কলা, লবণ প্রভৃতি। উৎপাদনকারীরা জানান, গত তিন বছরে এসব কাঁচামালের দাম, উৎপাদন খরচ ও শ্রমিকের মজুরি অনেক বেড়েছে। বিশেষ করে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর বিস্কুট তৈরির বিভিন্ন কাঁচামালের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়ে বিস্কুট খাতেও।
বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. রেজাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, কাঁচামালের দাম বাড়লেও সে তুলনায় বিস্কুটের দাম বাড়ানো যাচ্ছে না। এ কারণে অল্প কিছু দাম বাড়িয়ে কিংবা পরিমাণ কমিয়ে খরচ সমন্বয় করছেন ব্যবসায়ীরা।
উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে বিস্কুট তৈরি করে তৃপ্তি ফুড অ্যান্ড বেকারি। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আল আমিন বলেন, ‘গত এক বছরে আমি প্যাকেট (৩৫০ গ্রাম) প্রতি ৫ টাকা করে দাম বাড়িয়েছি। তাতে বিক্রিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। আগের তুলনায় লাভের পরিমাণ কমেছে; আবার চাহিদা কম থাকলে মাঝেমধ্যে লোকসানও হচ্ছে।’
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য অনুসারে, দেশে ২০২১ সালের মে মাসে ১ কেজি খোলা ময়দার দাম ছিল সর্বনিম্ন ৩৫ টাকা। এখন সেই ময়দা বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি সর্বনিম্ন ৫৫ টাকায়। অর্থাৎ তিন বছরে ময়দার সর্বনিম্ন দাম প্রায় ৫৭ শতাংশ বেড়েছে। অবশ্য গত বছর ময়দার দাম কেজিতে আরও ৩-৫ টাকা বেশি ছিল। বিস্কুট তৈরির অন্যতম মূল উপাদান এটি।
শুধু ময়দা নয়, বিস্কুটের অন্যান্য কাঁচামালের দামও অনেক বেড়েছে। যেমন ২০২১ সালে এক লিটার খোলা সয়াবিন তেলের দাম ছিল ১১৮-১২২ টাকা। গত বছর তা বৃদ্ধি পেয়ে প্রতি লিটার ১৭৫-১৮৫ টাকা হয়। চলতি বছর সেই দাম কিছুটা কমে ১৪৫-১৫০ টাকা হয়েছে। এ ছাড়া পাম তেলের দামও গত তিন বছরে লিটারপ্রতি সর্বনিম্ন ১৮ টাকা বেড়েছে।
চিনির মূল্যবৃদ্ধিও বিস্কুট উৎপাদকদের ভোগাচ্ছে। টিসিবির হিসাবে ২০২১ সালে প্রতি কেজি চিনির দাম ছিল ৭৩-৭৫ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি চিনি ১২৫-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ তিন বছরে চিনির কেজিতে অন্তত ৫২ টাকা দাম বেড়েছে। অনেক বিস্কুটে মুরগির ডিম ব্যবহার করা হয়। কেক তৈরিতে ডিম লাগেই। তিন বছর আগে ফার্মের মুরগির বাদামি ডিম প্রতি ডজন ৮৪-৯০ টাকায় বিক্রি হতো, যা এখন ১৪৪-১৫০ টাকা হয়েছে।
বিস্কুটের স্বাদ বাড়াতে ও ঘ্রাণ (ফ্লেভার) যোগ করতে বিভিন্ন আমদানি করা উপকরণ ব্যবহার করা হয়। মার্কিন ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখানেও ব্যয় বেড়েছে। ২০২১ সালের মে মাসে দেশে ১ ডলারের বিনিময়মূল্য ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। বর্তমানে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রলিং পেগ পদ্ধতিতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ১১৭ টাকা হয়েছে। গত বছরের জানুয়ারিতে সরকার শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে। এ ছাড়া গত বছর তিন দফায় বিদ্যুতের দাম ৫ শতাংশ করে বাড়ানো হয়। এ বছর বাড়ানো হয়েছে ৮ শতাংশ। গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিও বিস্কুট উৎপাদন খরচ বাড়ার পেছনে প্রত্যক্ষ প্রভাব রেখেছে।
বাংলাদেশ ব্রেড, বিস্কুট ও কনফেকশনারি প্রস্তুতকারক সমিতির অধীনে সারা দেশে প্রায় সাত হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সমিতির তথ্য অনুযায়ী, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির কারণে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে ২০০টির মতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। বাকিরা অনেকটা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ব্যবসায় টিকে রয়েছে।
বর্তমানে হাতে তৈরি বিস্কুটের ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে ২০০ টাকা পর্যন্ত মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট) অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। আসছে বাজেটেও এই সুবিধা বহাল রাখার দাবি এই সমিতির। তারা বলছে, কাঁচামালের দাম তো কমছে না। এখন ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধা অব্যাহত থাকলে ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো বাজারে টিকে থাকতে পারবে।