গ্যাসের সংকট কাটেনি, দিনের পর দিন লোকসান গুনছে শিল্প

গ্যাসপ্রতীকী ছবি

গাজীপুরের শ্রীপুরে এশিয়া কম্পোজিট মিলসে দৈনিক সুতা উৎপাদন সক্ষমতা ৮৫-৯০ টন। তবে গ্যাস-সংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে সক্ষমতার তুলনায় ৩০-৪০ শতাংশ কম উৎপাদন হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মাসুদ রানা প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন কম হওয়ায় খরচ বেড়ে যাচ্ছে। তাতে বড় অঙ্কের লোকসান হচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গ্যাসের সরবরাহ না বাড়ালে অনেক শিল্পকারখানা ধীরে ধীরে রুগ্‌ণ হয়ে যাবে। তাতে কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

এশিয়া কম্পোজিট মিলসের মতো দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের শিল্পকারখানা সাড়ে চার মাস ধরে তীব্র গ্যাস-সংকটে ভুগছে। বস্ত্রকল, সিরামিক ও ইস্পাত খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস-সংকটে মাসের পর মাস উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে বড় ধরনের লোকসানে পড়ছে বিভিন্ন শিল্পকারখানা। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে ভবিষ্যতে ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি এড়ানো অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হবে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন না বাড়ায় গ্যাসের সংকট কাটছে না। বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) বলছে, দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস খাত চলছে রেশনিং (এক খাতে সরবরাহ কমিয়ে অন্য খাতে দেওয়া) করে। দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া হয়। কোনো কারণে সরবরাহ এর চেয়ে কমলেই বেড়ে যায় সংকট। বর্তমানে সরবরাহ হচ্ছে ২৭১ কোটি ঘনফুট।

আরও পড়ুন

বর্তমানে দিনে দেশের গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন হচ্ছে ২০০ কোটি ঘনফুট। বাকিটা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে আসে। আমদানি করা এলএনজি রূপান্তর করে পাইপলাইনে সরবরাহের জন্য কক্সবাজারের মহেশখালীতে দুটি ভাসমান টার্মিনাল আছে। এর মধ্যে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল থেকে ৬০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গত ২৭ মে থেকে বন্ধ আছে সামিটের টার্মিনাল। এতে গ্যাস সরবরাহ কমে যায় ৫০ কোটি ঘনফুট। গত মাসে সামিটের টার্মিনালটি চালু হয়। তবে বিদেশ থেকে এলএনজিবাহী জাহাজ না আসায় গ্যাস সরবরাহ বাড়ছিল না। তবে গত সপ্তাহে একটি এলএনজিবাহী জাহাজ এসেছে বলে জানায় পেট্রোবাংলা।

লিটল গ্রুপ অব কোম্পানিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইনটিমেট স্পিনিং মিলস ও লিটল স্টার স্পিনিং মিলসের কারখানা যথাক্রমে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ও ঢাকার সাভারে। গ্যাস-সংকটের কারণে দুটি সুতার কলের উৎপাদন অর্ধেকে নেমেছে। শুধু গত মাসেই প্রতিষ্ঠান দুটি পৌনে ২ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে।

এমন তথ্য দিয়ে লিটল গ্রুপ অব কোম্পানিজের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, কারখানায় দিনে গ্যাসের চাপ ২-৩ পিএসআই পর্যন্ত পাওয়া যায়। আর রাতে সর্বোচ্চ ৪ পিএসআই। ফলে উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা টেকানো সম্ভব হবে না। শিল্প বাঁচাতে হলে সরকারকে গ্যাস আমদানির জন্য ডলার দিতে হবে। বস্ত্র খাতে ১ ডলারের গ্যাস ব্যবহার করে ৪ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।

এদিকে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর নেতারা গত মাসে সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেন, জ্বালানি সংকটের কারণে বেশির ভাগ কারখানা তাদের সক্ষমতার ৩০-৪০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছে না। তাতে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো।

ঢাকার কোনাপাড়া এলাকার শাহরিয়ার স্টিল মিলসও গ্যাস-সংকটে ভুগছে। তবে রডের চাহিদা কমে যাওয়ায় তাদের উৎপাদন স্বাভাবিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে গ্যাসের সংকট তাদের ওপর এখনো সেভাবে প্রভাব ফেলছে না।

শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কারখানায় তিন শিফটে উৎপাদন হয়। রডের চাহিদা কমে যাওয়ায় এখন এক শিফটে উৎপাদন হচ্ছে। রাতে যখন গ্যাসের চাপ বেশি থাকে, তখন রডের উৎপাদন হয়। উৎপাদন আগের মতো স্বাভাবিক থাকলে আমাদেরও ভুগতে হতো।’

আরও পড়ুন

গ্যাস-সংকটে সিরামিক কারখানার উৎপাদনও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। সিরামিক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিসিএমইএর নেতারা বলছেন, তীব্র গ্যাস-সংকটে ২২-২৫টি সিরামিক কারখানার উৎপাদন কমে গেছে। কারখানাগুলোতে যেখানে ১৫ পিএসআই গ্যাস চাপ প্রয়োজন হয়, সেখানে গ্যাসের চাপ সর্বোচ্চ ২-৩ পিএসআই। কখনো কখনো তা শূন্যেও নেমে আসছে। ফলে উৎপাদন কমছে, লোকসান বাড়ছে।

বিসিএমইএর সভাপতি মো. সিরাজুল ইসলাম মোল্লা বলেন, গ্যাস-সংকটে অবর্ণনীয় দুর্ভোগে পড়েছে কোম্পানিগুলো। অনেক কারখানায় উৎপাদন সক্ষমতার ২০ শতাংশের বেশি উৎপাদন হয় না। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে পারছে না কোনো কোনো কোম্পানি। কেউ কেউ ব্যাংকঋণের কিস্তিও পরিশোধ পারতে পারছে না।

গ্যাস সরবরাহ পরিস্থিতির কবে উন্নতি হবে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এলএনজিবাহী একটি জাহাজ মহেশখালীতে পৌঁছেছে। ফলে শিগগিরই ভাসমান টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ ১০০ কোটি ঘনফুটের বেশি হবে। এতে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।