তৈরি পোশাক খাত ব্যবসায় এগিয়ে, মজুরিতে পিছিয়ে
আজ নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় মজুরি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মালিকপক্ষ ১২ হাজার টাকার বেশি মজুরির প্রস্তাব দিতে পারেন।
অল্প সময়ের ব্যতিক্রম ছাড়া এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এই সময়ে তাজরীন ফ্যাশনসের অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজা ধস ও করোনার ধাক্কার পরও পোশাকের ব্যবসা বেড়েছে। সুনির্দিষ্ট করে বললে, গত ১০ বছরেই (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল) তৈরি পোশাকের রপ্তানি ১৩০ শতাংশ বেড়েছে।
ব্যবসা বাড়ার পাশাপাশি সরকারের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার দিক থেকেও তৈরি পোশাকশিল্প এগিয়ে রয়েছে। অন্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে পোশাক কারখানার জন্য এই করের হার ১০-১২ শতাংশ। এর বাইরে এই শিল্পের জন্য নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া এবং শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধাও আছে।
অভ্যন্তরীণ ও দেশের বাইরের সংকটের মধ্যেও ব্যবসা বা রপ্তানি ও নানা রকম সুবিধা পাওয়ায় এগিয়ে থাকলেও শ্রমিকের মজুরি দেওয়ায় প্রতিযোগী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। ভারত, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের পোশাকশ্রমিকেরা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মজুরি পান। শুধু তাই নয়, দেশের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের তুলনায়ও কম মজুরি দিচ্ছে শীর্ষ রপ্তানি আয়ের এই খাত।
জানা গেছে, মালিকপক্ষ ১২ হাজার টাকার বেশি মজুরির প্রস্তাব দিতে পারেন। তবে মালিকদের সেই প্রস্তাবের কাছাকাছি মজুরি চূড়ান্ত হলে শ্রমিকেরা তাতে সন্তুষ্ট হবেন কি না, তা নিয়ে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সংশয় প্রকাশ করেছেন।
প্রত্যেকবার মজুরি বাড়ানোর সময় বিভিন্ন অজুহাতে মালিকপক্ষ কম মজুরি বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের প্রতিনিধির দেওয়া ২০ হাজার ৩৯৩ টাকার প্রস্তাবের বিপরীতে মালিকপক্ষ এর প্রায় অর্ধেক বা ১০ হাজার ৪০০ টাকার প্রস্তাব দেয়। ফলে ক্ষুব্ধ হয়ে শ্রমিকেরা আন্দোলনে নামেন। আন্দোলন সহিংস ওঠার পর মালিকপক্ষ বোর্ডে নতুন মজুরি প্রস্তাব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়। তার আগে গাজীপুরের দুজন পোশাকশ্রমিক মারা যান।
আজ মঙ্গলবার নিম্নতম মজুরি বোর্ডের ষষ্ঠ সভায় মজুরি চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জানা গেছে, মালিকপক্ষ ১২ হাজার টাকার বেশি মজুরির প্রস্তাব দিতে পারেন। তবে মালিকদের সেই প্রস্তাবের কাছাকাছি মজুরি চূড়ান্ত হলে শ্রমিকেরা তাতে সন্তুষ্ট হবেন কি না, তা নিয়ে কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের শীর্ষ নেতারা সংশয় প্রকাশ করেছেন।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত মাসে এক গবেষণায় দেখিয়েছে, শ্রমিকের মাসিক নিম্নতম মজুরি হওয়া দরকার ১৭ হাজার ৫৬৮ টাকা। বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান যদি প্রতিটি পোশাকে অতিরিক্ত ৭ সেন্ট করে দেয়, তাহলে বাড়তি মজুরি দিতে কারখানা মালিকদের ওপর কোনো চাপ পড়বে না বলে মনে করেন সংস্থাটির গবেষকেরা।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘মজুরি নির্ধারণের সময় পোশাকশিল্পের মালিকেরা প্রায়ই নীতিনির্ধারকদের কারখানার সক্ষমতা নেই, কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে কিংবা শ্রমিকেরা বেকার হয়ে যাবেন—এমন ভয় দেখান। এই যুক্তিগুলো অসাড়। অতীতে যতবার মজুরি বেড়েছে, ততবারই কারখানাগুলো সেই মজুরি দিতে পেরেছে। রপ্তানিও বেড়েছে। সেটাই এই খাতের সক্ষমতা প্রমাণ করে।’ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘আমরা গবেষণা করে দেখেছি, বেশির ভাগ কারখানার বাড়তি মজুরি দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কারণ, গত কয়েক বছরে ছোট, মাঝারি ও বড়—সব আকারের কারখানার রপ্তানি বেড়েছে।
ব্র্যান্ড বা ক্রেতার সংখ্যাও বেড়েছে। কারখানার আকারও বড় হয়েছে। ফলে মালিকেরা যে ধরনের জুজুর কথা বলেন, তা গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব কারখানা বন্ধ হওয়ার যুক্তি দেওয়া হয়, সেগুলো কোনো যুক্তিতেই টিকে থাকতে পারবে না।’
কয়েকজন পোশাকশিল্পের মালিক বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে পোশাকের ক্রয়াদেশ তুলনামূলক কম। দেড় বছরের ব্যবধানে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে ২৭ শতাংশ। এতে করে কাঁচামাল ও গ্যাস-বিদ্যুতের দামও বেড়েছে। তবে পোশাক রপ্তানি করে প্রাপ্ত ডলারে আগের চেয়ে বেশি টাকা পাচ্ছেন মালিকেরা।
১০ বছরে রপ্তানি আড়াই গুণ
গত এক দশকে চারটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছর রানা প্লাজা ধসের কারণে পোশাক রপ্তানিতে সাময়িক মন্দা আসে। তবে পোশাক কারখানায় কর্মপরিবেশ উন্নয়নে প্রচুর কাজ করায় ক্রেতাদের আস্থা ফিরে। রপ্তানিও বাড়ে। মাঝে কোভিড মহামারির কারণে পোশাকশিল্পের কঠিন সময় গেছে। তারপর আবার ব্যবসা ঘুরে দাঁড়ায়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরেক দফা চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে দেশের পোশাক খাত।
এত কিছুর পরও তৈরি পোশাকের রপ্তানি ২০১৩ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে ২ দশমিক ৩০ গুণ বেড়েছে। চলতি বছরের ১০ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৭৭ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি বৃদ্ধির পাশাপাশি পোশাক খাতের ব্যবসাও সুসংহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডার মতো প্রচলিত বাজারের ওপর নির্ভরশীলতাও কিছুটা কমে এসেছে। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, চীনের মতো নতুন বাজারে রপ্তানি বেড়ে চলেছে। গত বছর মোট পোশাক রপ্তানির ১৬ শতাংশের গন্তব্য ছিল নতুন বাজার।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্যানুযায়ী, বিশ্ববাজারে গত বছর তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি হিস্যা (মার্কেট শেয়ার) ছিল চীনের, ৩১ দশমিক ৭ শতাংশ। তারপরই বাংলাদেশের অবস্থান, হিস্যা ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। এ ছাড়া ভিয়েতনামের হিস্যা ৬ দশমিক ১ শতাংশ, তুরস্কের সাড়ে ৩ শতাংশ এবং ভারতের ৩ দশমিক ১ শতাংশ।
গত এক দশকে চারটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে তৈরি পোশাকশিল্প। ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসে অগ্নিকাণ্ড এবং পরের বছর রানা প্লাজা ধসের কারণে পোশাক রপ্তানিতে সাময়িক মন্দা আসে।
৩,৫০০ কোটি টাকার করছাড়
তিন দশকের বেশি সময় ধরে তৈরি পোশাক খাত বিভিন্ন ধরনের কর সুবিধা পেয়ে আসছে। বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা ধরে রাখার লক্ষ্যের কথা বলে মালিকেরা এখনো প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকার করছাড় আদায় করে নিচ্ছেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে পোশাক, বস্ত্র ও আনুষঙ্গিক খাতকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকার করছাড় দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার বিভিন্ন শর্তের একটি হচ্ছে, এই করছাড় কমাতে হবে।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পোশাক খাতে করপোরেট করহার সবচেয়ে কম। মাত্র ১২ শতাংশ। পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা হলে করপোরেট করহার মাত্র ১০ শতাংশ। তবে রপ্তানিকারককে বছর শেষে এই কর দিতে হয় না। রপ্তানিকালে মোট রপ্তানি মূল্যের (এফওবি মূল্য) ওপর ১ শতাংশ উৎসে কর দিলেই তা পরে করপোরেট করের সঙ্গে সমন্বয় হয়ে যায়। যদিও অন্য খাতের প্রতিষ্ঠানকে ২০ থেকে ৪৫ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হয়।
এনবিআর সূত্র জানায়, পোশাক ও আনুষঙ্গিক খাত থেকে সব মিলিয়ে বছরে দুই হাজার কোটি টাকার মতো কর আদায় হয়। তবে যত আদায় হয়, তার চেয়ে ১৭৫ শতাংশ বেশি করছাড় দেওয়া হয়।
চার দশক ধরে এই খাতটিকে যত ধরনের কর সুবিধা দেওয়া যায়, সবই দেওয়া হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে এই কর সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। চার দশকে যদি একটি শিল্প দাঁড়াতে না পারে, তবে কবে দাঁড়াবে?
আয়কর ছাড়াও বিভিন্ন বাজারে ১৫ শতাংশ নগদ সহায়তা পায় পোশাকশিল্প। বন্ড সুবিধাও পান পোশাকমালিকেরা। এই সুবিধার আওতায় পোশাক খাতের কাঁচামাল যেমন সুতা, কাপড়সহ বিভিন্ন পণ্য বিদেশ থেকে আনতে কোনো শুল্ক-কর দিতে হয় না। এ ছাড়া পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট খাত যেমন প্যাকেজিং, অ্যাকসেসরিজ খাতও এই বন্ড সুবিধা পায়। চামড়া খাতসহ হাতে গোনা কয়েকটি খাত শুধু বন্ড সুবিধা পায়। অন্য খাতগুলো এসব সুবিধা পায় না।
বন্ড সুবিধায় কত শুল্ক-কর ছাড় দেওয়া হয়, তা নিয়ে দুই বছর আগে একটি গবেষণা করেছে এনবিআর। সেখানে বলা হয়, ২০১৯-২০ অর্থবছরেই বন্ড সুবিধার আওতায় ১ লাখ ৫১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকার শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়েছে। এর প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি শুল্ক-কর ছাড় পেয়েছে বস্ত্র খাত। মূলধনি যন্ত্রপাতিসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি আনতে রেয়াতি হারে কর সুবিধা পায় পোশাকশিল্প। এ ছাড়া পোশাকশিল্পের মালিকেরা বাড়ি-গাড়ি নিজেদের প্রতিষ্ঠানের নামে দেখিয়ে করছাড় পেয়ে যান।
জানতে চাইলে এনবিআরের আয়কর বিভাগের সাবেক সদস্য সৈয়দ আমিনুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘চার দশক ধরে এই খাতটিকে যত ধরনের কর সুবিধা দেওয়া যায়, সবই দেওয়া হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে এই কর সুবিধা উঠিয়ে নেওয়ার সময় এসেছে। চার দশকে যদি একটি শিল্প দাঁড়াতে না পারে, তবে কবে দাঁড়াবে?’
পোশাকশ্রমিকের মজুরি কম
২০১৮ সালে ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৩ টাকা ৯০ পয়সা। তখন নিম্নতম মজুরি ছিল ৮ হাজার টাকা, যা তখনকার বিনিময় হারের হিসাবে ৯৫ ডলার ৩৫ সেন্ট। এখন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। ডলারের বর্তমান বিনিময় হার হিসাব করলে এখন পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি ৭২ ডলারে দাঁড়ায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্তমানে ভারতে পোশাকশ্রমিকের নিম্নতম মজুরি ১৭১ মার্কিন ডলার। এ ছাড়া চীনে ৩০৩, কম্বোডিয়ায় ২০০, ইন্দোনেশিয়ায় ২৪২, ভিয়েতনামে ১৭০ এবং পাকিস্তানে ১১০ ডলার। বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি। চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোও (কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান) এ ক্ষেত্রে এগিয়ে।
সিপিডির গবেষণা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, একজন শ্রমিক প্রতি মাসে গড়ে ২ হাজার ৩০ ডলার বা ২ লাখ ২৪ হাজার টাকা মূল্যের রপ্তানিযোগ্য পোশাক তৈরি করেন। ২০১৭ সালে এই পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৬৮ হাজার টাকা। পরের বছরগুলোতে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মজুরিকাঠামোতে অনেকগুলো গ্রেড আছে। তার মধ্যে নিচের গ্রেড নিয়েই বেশি কথা হয়। ওপরের গ্রেডে শ্রমিকেরা আরও বেশি মজুরি পায়। অন্যদিকে অন্য দেশের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম। ভিয়েতনামের শ্রমিকেরা এক ঘণ্টায় ৩০০টি টি–শার্ট উৎপাদন করে। শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাটি ৩৫০ আর চীনে ৪০০। আর আমাদের দেশে মাত্র ২০০। ফলে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের মজুরি কোনো অংশে কম নয়।’
বাংলাদেশে মাথাপিছু জিডিপির মাত্র ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ পোশাকশ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি। চীন ছাড়া অন্য দেশগুলোও (কম্বোডিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তান) এ ক্ষেত্রে এগিয়ে।
চ্যালেঞ্জ যখন মালিকের হাতিয়ার
নিম্নতম মজুরি বোর্ডে গত ২২ অক্টোবর মালিকপক্ষের প্রতিনিধি সিদ্দিকুর রহমান যে মজুরি প্রস্তাব জমা দেন, তার অধিকাংশজুড়েই ছিল বিভিন্ন সমস্যার কথা। তাতে বলা হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। ফলে নিত্যপণ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দিয়েছেন ভোক্তারা। এতে পোশাকের বিক্রি কমে আসতে শুরু করে। ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়ীরা পোশাক আমদানি আশঙ্কাজনক হারে কমিয়ে দেন।
মালিকপক্ষের প্রস্তাবে আরও বলা হয়, ‘দেশে গত পাঁচ বছরে জ্বালানি তেলের দাম ৬৮ শতাংশ এবং গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম যথাক্রমে ১৮০ ও ২১ শতাংশ বেড়েছে। সামগ্রিকভাবে গত পাঁচ বছরে পোশাকশিল্পের গড় উৎপাদন ব্যয় ৪০ শতাংশ বেড়েছে। পোশাক খাত এখনো করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যুদ্ধের কারণে কাঁচামালসহ অন্যান্য উৎপাদন ব্যয় যেভাবে বেড়েছে, সেভাবে আমাদের পণ্যের মূল্য বাড়েনি।’
ভিয়েতনামের শ্রমিকেরা এক ঘণ্টায় ৩০০টি টি–শার্ট উৎপাদন করে। শ্রীলঙ্কায় সংখ্যাটি ৩৫০ আর চীনে ৪০০। আর আমাদের দেশে মাত্র ২০০। ফলে প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমাদের শ্রমিকদের মজুরি কোনো অংশে কম নয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন পোশাকশিল্পের মালিক প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বর্তমানে একটু সমস্যার মধ্যে যাচ্ছি আমরা। ক্রয়াদেশ কিছুটা কম। তবে আশা করছি, দ্রুত পরিস্থিতির উন্নতি হবে। যখন সব কারখানায় মজুরি বাড়বে, তখন ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়াতে বাধ্য হবে। তবে তারা খুব বেশি দেবে না। কারখানাগুলোতে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়েই টিকে থাকতে হবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ৫-৬ শতাংশ উৎপাদনশীলতা বাড়ানো বাধ্যতামূলক।’
জানতে চাইলে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকশিল্পের মালিকেরা দ্বৈত ভূমিকায় রয়েছেন। তাঁরা সরকারের অংশ, আবার তাঁরা শিল্পেরও মালিক।শ্রমিকদের দমন–পীড়নের কারণে মালিকদের কখনো জবাবদিহির মুখে পড়তে হয় না। সে জন্যই শ্রমিকদের কম মজুরি দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তবে এভাবে শিল্পকে টেকসই করা যাবে না। পোশাক আমদানিকারক দেশগুলোতে আইন হচ্ছে, শ্রমিকদের বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় মজুরি দিতে হবে। তাই বেশি দিন এভাবে চলা যাবে না।