গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকট
সিরামিক কারখানাগুলো ধুঁকছে
কারখানাভেদে উৎপাদন ১০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আবার ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি খরচ বেড়েছে।
ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সিরামিকের তৈজসপত্র (টেবিলওয়্যার) রপ্তানি করে আর্টিসান সিরামিকস। গাজীপুরে তাদের কারখানায় দিনে সাত টন তৈজসপত্র উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। বর্তমানেও ভরপুর ক্রয়াদেশ আছে। তবে গ্যাসসংকটের কারণে তাদের উৎপাদন অর্ধেক কমে গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে আর্টিসান সিরামিকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মামুনূর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিকেল পাঁচটা থেকে ভোর পাঁচটা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ না থাকায় উৎপাদন ৫০ শতাংশের মতো কমে গেছে। গ্যাসসংকটের কারণে কয়েক মাস ধরে লোকসান গুনছি। আরও তিন-চার মাস এমন অবস্থা থাকলে কারখানা বন্ধ করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প থাকবে না।’
প্রতিটি কোম্পানিকেই লোকসান দিতে হচ্ছে। আমরা সিরামিক খাতের ব্যবসায়ীরা কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। কঠিন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।
উৎপাদন কমে যাওয়ায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানান মামুনূর রশীদ। তিনি বলেন, ‘বিদেশি ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য দিতে পারছি না। তাতে ক্রয়াদেশ অন্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে। করোনার কারণে চীনের রপ্তানিকারকেরা সমস্যায় আছে। ইউরোপেও গ্যাসসংকট চরমে।’ সেটি না হলে সব ক্রয়াদেশই চলে যেত বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আর্টিসান সিরামিকসের মতো সিরামিকশিল্পের অনেক কারখানাই গ্যাসসংকটের কারণে সক্ষমতা অনুযায়ী উৎপাদন করতে পারছে না। কারণ, সিরামিক কারখানার জন্য গ্যাস অতিপ্রয়োজনীয় জ্বালানি। তবে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়েও বিপাকে পড়ছে তারা। যদিও এলাকাভেদে কিছু কারখানায় গ্যাসের সমস্যা হচ্ছে না। যেমন ভোলায় শেল্টেকের কারখানায় গ্যাসসংকট নেই।
খাতসংশ্লিষ্ট কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, গ্যাসসংকটে কারখানাভেদে উৎপাদন ১০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আবার ডলারের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় কাঁচামাল আমদানি খরচও বেড়েছে। এ কারণে সিরামিক পণ্যের দাম বাড়ানোর জন্য হিসাব–নিকাশ শুরু করছে কোম্পানিগুলো। দাম বাড়ানো হলে বিক্রিও কমে যাবে। চলতি বছরই এক দফা দাম বাড়িয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বাংলাদেশ সিরামিক পণ্য উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, সিরামিক খাতে বর্তমানে ৭০টি প্রতিষ্ঠান আছে। এর মধ্যে তৈজসপত্রের ২০টি, টাইলসের ৩২টি ও স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনের ১৮টি কারখানা। সিরামিক পণ্য উৎপাদনে মূল্য
সংযোজন ৬৫ শতাংশ। সব মিলিয়ে সিরামিকশিল্পে ১৫৭ কোটি ডলার বা ১৩ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়েছে। খাতটিতে ৫০ হাজারের বেশি মানুষের কর্মসংস্থান।
তৈজসপত্র উৎপাদনকারী ২০ প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৩০ কোটি পিস। তারাই তৈজসপত্রের দেশীয় চাহিদার ৮৬ শতাংশ পূরণ করে। ৩২টি টাইলস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান দেশীয় চাহিদার ৮৭ শতাংশ জোগান দেয়। তাদের বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ২০ কোটি বর্গমিটার টাইলস। স্যানিটারি পণ্যের দেশীয় চাহিদার ৬০ শতাংশ পূরণ করছে ১৮টি স্যানিটারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বাকিটা বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
গাজীপুরের শ্রীপুরের মাওনায় এক্স সিরামিকের কারখানা। তাদের দৈনিক উৎপাদনক্ষমতা ৩০ হাজার বর্গমিটার সিরামিক টাইলস। তবে গ্যাসসংকটের কারণে বর্তমানে সক্ষমতার বড় অংশই কাজে লাগাতে পারছে না কোম্পানিটি। আবার মান ভালো না হওয়ায় উৎপাদিত টাইলসের একটা অংশ ফেলে দিতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে এক্স সিরামিকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মামুনূর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, টাইলস উৎপাদনে একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিক সময়ে ৯৫-৯৬ শতাংশ টাইলস ভালো মানের, অর্থাৎ ‘এ’ গ্রেডের হয়। বর্তমানে গ্যাসের চাপ হঠাৎ কমে যাওয়ায় সেটি ৭০-৭৫ শতাংশে নেমে এসেছে। ‘বি’ গ্রেডের টাইলস হচ্ছে ১০-১২ শতাংশ। বাকিটা ‘সি’ গ্রেডের, যার পুরোটাই ধ্বংস করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে মনে হচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর শেষে কোম্পানির রাজস্ব ২০-২৫ শতাংশ কমবে।
জানা যায়, সরবরাহের সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া, তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপাতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। ডলারের ওপর চাপ কমাতে কোরবানির ঈদের পর দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। শিল্পকারখানা লোডশেডিংয়ের আওতামুক্ত হলেও সেটি মানতে পারছে না বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাগুলো।
গ্রেটওয়াল সিরামিকের দুই কারখানা গাজীপুর ও হবিগঞ্জের মাধবপুরে। গ্যাসসংকটের কারণে গাজীপুরের টাইলস কারখানার পাঁচটি চুল্লির মধ্যে দুটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হচ্ছে তারা। তবে মাধবপুরের কারখানায় পুরোদমেই উৎপাদন চলছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে গ্রেটওয়াল সিরামিকের ব্যবস্থাপক আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গাজীপুরের কারখানায় দিনে ১ কোটি ২০ লাখ বর্গফুট টাইলস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। তবে দিনে ছয় ঘণ্টা গ্যাস থাকছে না। অন্যান্য সময়ও হঠাৎ হঠাৎ চাপ কমে যাওয়ায় চুল্লির সংখ্যা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে আমাদের উৎপাদন কমেছে কমপক্ষে ১০ শতাংশ।’
সিরামিক খাতের প্রায় সব কাঁচামালই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। এ খাতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্লে বা কাদামাটি, যা প্রয়োজনীয় কাঁচামালের ৬০ শতাংশ। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ১০ লাখ ১৫ হাজার টন ক্লে আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ১১ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। তার আগের বছর ৯ লাখ ৬৭ হাজার টন ক্লে আমদানিতে ব্যয় হয়েছিল ৮ কোটি ৭৩ লাখ ডলার। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম এক দফা বেড়েছে। বর্তমানে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমদানি খরচ আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাঁচামালের দাম আগেই ৪০-৫০ শতাংশ বেড়েছে। আবার জাহাজভাড়াও কমপক্ষে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮৪ টাকার ডলারের দাম বেড়ে হয়েছে ১১০ টাকা পর্যন্ত। এমন পরিস্থিতিতে প্রতিটি কোম্পানিকেই লোকসান দিতে হচ্ছে। আমরা সিরামিক খাতের ব্যবসায়ীরা কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। কঠিন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি।’