নতুন বাজারে শক্ত ভিত বাংলাদেশের

একসময় বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের সাড়ে ৯২ শতাংশের গন্তব্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা। প্রচলিত এই বাজারের বাইরে অন্যান্য দেশ বা নতুন বাজারের হিস্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ, যা বেড়ে এখন ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশ হয়েছে। এর মধ্য দিয়েই দেশের তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন এক রূপান্তরের ঢেউ লেগেছে।

তৈরি পোশাক রপ্তানিতে পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণের জন্য এক দশকের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চলছে। সেই চেষ্টায় পুরোপুরি সফলতা না এলেও অগ্রগতি আছে। বেশ কিছু কারখানা এখন ভ্যালু অ্যাডেড বা বেশি দামের বৈচিত্র্যময় তৈরি পোশাক রপ্তানি করছে। আবার প্রচলিত বাজারের ওপর অতিনির্ভরতাও কাটতে শুরু করেছে। রপ্তানিতে নতুন বাজারের হিস্যা বাড়ছে। এতে তৈরি পোশাকশিল্পে নতুন এক রূপান্তরের ঢেউ লেগেছে।

২০০৯ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানির ৫৮ দশমিক ৯০ শতাংশের গন্তব্য ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। ইইউ জোটে তখন যুক্তরাজ্যও ছিল। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ এবং কানাডায় ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ পোশাক রপ্তানি হতো। তার মানে, রপ্তানি হওয়া তৈরি পোশাকের সাড়ে ৯২ শতাংশের গন্তব্য ছিল প্রচলিত বাজারগুলো। সে সময় নতুন বাজারের হিস্যা ছিল মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ।

দেড় দশকের ব্যবধানে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে নতুন বাজারের হিস্যা বেড়ে ১৮ দশমিক ৭২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। তাতে প্রচলিত বাজারগুলোর ওপর অতিনির্ভরতা কমে আসছে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রে বাজার হিস্যা ২৮ দশমিক ৭০ শতাংশ থেকে কমে ১৭ দশমিক ৪৬ শতাংশে নেমেছে। একইভাবে কানাডার হিস্যা ৪ দশমিক ৮৬ শতাংশ থেকে কমে গত বছর ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ হয়েছে। যদিও ইইউর হিস্যা খুব একটা কমেনি, বেড়েছে যুক্তরাজ্যের হিস্যা।

জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘নতুন বাজারে নীরব বিপ্লব মূলত সবার চেষ্টার ফল। যদিও চেষ্টাগুলো হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে। আমাদের উদ্যোক্তারা চেষ্টা করে চলেছেন। সরকারের উদ্যোগ ছিল। ক্রেতারাও চেষ্টা করেছেন।’

নির্দিষ্ট দু-তিনটি বাজারের ওপর নির্ভরশীল থাকলে বড় বিপত্তির শঙ্কা থাকে। আবার পোশাক রপ্তানি বাড়াতে হলে ছোট-বড় সব বাজারেই সরব উপস্থিতি থাকতে হবে—এই দুটি কারণে নতুন বাজারে হিস্যা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন ফজলুল হক। তিনি বলেন, নতুন বাজারে পোশাক রপ্তানির হিস্যা ৪০ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সেই সম্ভাবনা রয়েছে। এখন বাংলাদেশের নাম সবাই জানে। ফলে পরিকল্পিতভাবে এগোলে রপ্তানি বাড়ানো আগের চেয়ে সহজ হবে।

আলাপচারিতায় ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ভালো সম্ভাবনা রয়েছে। এসব অঞ্চলের একটি দেশকে টার্গেট করে দু-তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। তাহলেই আশপাশের দেশগুলোতে খবর পৌঁছে যাবে।

আশির দশকে উদ্যোক্তাদের চেষ্টা আর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ওপর ভর করে দেশে তৈরি পোশাক খাত গড়ে ওঠে। শুরুতে ডিউটি ড্র ব্যাক ও পরে বন্ড সুবিধা চালু হয়। এরপর সরকার চালু করে স্থানীয় ঋণপত্র বা ব্যাক-টু-ব্যাক এলসির ব্যবস্থা। ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি বাড়াতে বস্ত্র ও পোশাক খাতকে ২৫ শতাংশ নগদ সুবিধা দেওয়া হয়। পরে তা ধাপে ধাপে কমিয়ে আনা হয়। নতুন বাজারে রপ্তানি বাড়াতে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।

‘নতুন বাজারের অর্জনটি ইতিবাচক। তবে তা বিশেষভাবে দু-তিনটি বাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০১০ সালে এক গবেষণায় আমরা ১৫টি সম্ভাবনাময় বাজারের তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেছিলাম। তার মধ্যে সেই বাজারেই আমরা ভালো করেছি, যেখানে আমাদের সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।’
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি।

নতুন বাজারে বেশি প্রবৃদ্ধি

গত দেড় দশকে রানা প্লাজা ধস ও করোনা মহামারির চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও তৈরি পোশাক রপ্তানি বেড়েছে প্রায় ৪ গুণ। ২০০৯ সালে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ছিল ১ হাজার ১৮৯ কোটি ডলার। বিদায়ী ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৭৩৯ কোটি ডলার।

বিদায়ী বছরে ইইউতে ২ হাজার ৩৩৮, যুক্তরাষ্ট্রে ৮২৭, যুক্তরাজ্যে ৫৩৪, কানাডায় ১৫১ এবং নতুন বাজারে ৮৮৭ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়। এর মানে, একসময় যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে পিছিয়ে থাকলেও বর্তমানে বাজারটি থেকে এগিয়ে গেছে নতুন বাজার। শুধু তা–ই নয়, প্রবৃদ্ধিও অন্য যেকোনো বাজারের চেয়ে ভালো।

২০২৩ সালে নতুন বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয় সাড়ে ২০ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি কমে ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশের মতো। অন্যদিকে ইইউতে দেড় শতাংশ, কানাডায় ১ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ১২ দশমিক ৪৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

নতুন বাজারে আরও সম্ভাবনা

নতুন বাজারে বড় চমক জাপান ও অস্ট্রেলিয়া। দীর্ঘদিন ধরে জাপানের বাজারে এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলারের ওপরে তৈরি পোশাক রপ্তানি হচ্ছে। গত বছর এই বাজারে পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৬৮ কোটি ডলার। তাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৬ দশমিক ৫৩ শতাংশ। অথচ এই বাজারে ২০০৯ সালে রপ্তানি ছিল ১১ কোটি ডলার। এর মানে, জাপানে গত ১৫ বছরে রপ্তানি বেড়েছে ১৫ গুণ।

বিদায়ী বছরে অস্ট্রেলিয়াতেও তৈরি পোশাক রপ্তানি এক বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করেছে বাংলাদেশ। ২০০৯ সালে এই বাজারে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৭ কোটি ডলারের। গত বছর সেটি ১২৮ কোটি ডলার হয়েছে। গত বছর অস্ট্রেলিয়ায় পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি হয় ৩৮ শতাংশ।

জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে না পৌঁছালেও ভারতের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি দ্রুতগতিতে বাড়ছে। ২০০৯ সালে বাজারটিতে পোশাক রপ্তানি হয়েছিল ৮০ লাখ ডলারের। ১০ বছরের ব্যবধানে ২০১৯ সালে সেই রপ্তানি বেড়ে ৫১ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। এরপরের বছর করোনার কারণে রপ্তানি কমে। গত দুই বছর দেশটিতে পোশাক রপ্তানি ছিল যথাক্রমে ৯০ ও ৯২ কোটি ডলার। বিদায়ী বছরে এই বাজারে প্রবৃদ্ধি হয় ২ দশমিক ২০ শতাংশ।

নতুন বাজারগুলোর মধ্যে শীর্ষ পাঁচে আরও আছে রাশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া। ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ানোর পর রাশিয়ায় তৈরি পোশাক রপ্তানি কিছুটা কমে। গত বছর রাশিয়ায় পোশাক রপ্তানি হয় ৪৮ কোটি ডলার। এ ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ।

অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পোশাক রপ্তানি ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০১৮ সালে বাজারটিতে রপ্তানি হয়েছিল ২৪ কোটি ডলারের। গত বছর সেটি বেড়ে ৫৯ কোটি ডলার হয়েছে। এ ছাড়া চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ডে পোশাক রপ্তানি বাড়ছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকেলেন, ‘নতুন বাজারের অর্জনটি ইতিবাচক। তবে তা বিশেষভাবে দু-তিনটি বাজারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ২০১০ সালে এক গবেষণায় আমরা ১৫টি সম্ভাবনাময় বাজারের তথ্য–উপাত্ত তুলে ধরেছিলাম। তার মধ্যে সেই বাজারেই আমরা ভালো করেছি, যেখানে আমাদের সরকার ও ব্যবসায়ী সংগঠন বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে।’

সিপিডির এই গবেষক আরও বলেন, নতুন বাজারে বড় চ্যালেঞ্জ শুল্ককাঠামো। অধিকাংশ দেশ উন্নয়নশীল দেশ হওয়ায় তাদের অঞ্চলের বাইরের দেশের পণ্য উচ্চ শুল্ক দিয়ে রপ্তানি করতে হয়। এসব দেশের সঙ্গে শুল্ক কমানোর জন্য দর–কষাকষি করতে হবে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পেরু ও মেক্সিকোর সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বা অগ্রাধিকারমূলক বাজারসুবিধা (পিটিএ) করা দরকার। এ ছাড়া কিছু দেশে ভাষাগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। ভিসা নিয়েও জটিলতা আছে। এসব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ লাগবে।