মঞ্জুর এলাহীর মতো ব্যবসায়ী উপমহাদেশে বিরল: রেহমান সোবহান
প্রয়াত ব্যবসায়ী সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী সব ক্ষেত্রেই অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। সৎ, নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে, শিক্ষানুরাগী আর সৎ ও শোভন মানুষ—কী ছিলেন না তিনি। এত গুণের সমাহার সাধারণত ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা যায় না।
শুক্রবার ঢাকা সেনানিবাসের সেনা প্রাঙ্গণে আয়োজিত প্রয়াত বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অ্যাপেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর দোয়া মাহফিলে বক্তারা এসব কথা বলেন।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সব ক্ষেত্রেই সততা, নিষ্ঠা ও শোভনতার অসাধারণ নজির স্থাপন করেছিলেন বলে মন্তব্য করেন গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান। বলেন, এ রকম নজির বিরল, বিশেষ করে এই ভারতীয় উপমহাদেশে। টাকাপয়সা হলে বা সফলতা এলে মানুষের মধ্যে সাধারণত ঔদ্ধত্য আসে। কিন্তু যাঁরা মঞ্জুর এলাহীকে চিনতেন, তাঁরা বলবেন, তাঁর মধ্যে কখনো অভদ্রতা দেখা যায়নি।
রেহমান সোবহান আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগেই ৯০ বছর পূর্ণ হলো আমার। এই বয়সে নিজের এক ছাত্রের স্মরণসভায় আসতে হলো, যদিও হওয়ার কথা ছিল উল্টো। তিনি কেন এত ভালো পরিবার ও বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সেই ১৯৬২ সালে ঢাকায় এসেছিলেন, তা রেহমান সোবহানের কাছে প্রথম ব্যাখ্যাহীন মনে হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তিনি ব্যবসায়ী হিসেবে যে উচ্চতায় উঠেছিলেন, তাতে ঢাকায় আসার সার্থকতা প্রমাণ করেছেন। তাঁর সন্দেহ, কলকাতায় থাকলে এত বড় ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তা হওয়া তাঁর পক্ষে সহজ হতো না।’
পেশা নির্বাচনেও মঞ্জুর এলাহী নিজের পথে হেঁটেছেন। তাঁর বাবা ছিলেন অবিভক্ত বাংলার প্রধান বিচারপতি, তাঁর ভাইও বিচারপতি, সেখানে তিনি প্রথমে গেলেন বহুজাতিক কোম্পানিতে এবং তারপর এলেন ব্যবসায়। সেখানেও তিনি সফল।
মঞ্জুর এলাহী সম্পর্কে তাঁর সহপাঠী ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, তিনি বিভিন্নভাবে ক্ষমতা লাভ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি কখনোই সেই পথে হাঁটেননি। বরং সব সময় সাহস, সততা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেন। সে কারণে করাচিতে বহুজাতিক কোম্পানির উচ্চ পদের চাকরি ছেড়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করেন। চামড়ার ব্যবসায় তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। শুধু তা–ই নয়, বাংলাদেশের চামড়া খাতকে রপ্তানি খাত হিসেবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী অত্যন্ত শিক্ষানুরাগী মানুষ ছিলেন বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। তিনি না থাকলে হয়তো ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাই হতো না। সেই বিশ্ববিদ্যালয় এখন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন আরও বলেন, ‘অত্যন্ত বন্ধুবৎসল মানুষ ছিলেন মঞ্জুর এলাহী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে তাঁর যে কক্ষসঙ্গী ছিলেন দুজন, আজীবন তাঁদের খোঁজ নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া আমাদের বন্ধুদের মধ্যে অনেকের জন্যই তিনি অনেক কিছু করেছেন, যার সাক্ষী তিনি নিজে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ছিলেন একজন সফল উদ্যোক্তা। তাঁর হাত ধরেই বহু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। তিনি ছিলেন এ দেশের ব্যবসায়ীদের কাছে ব্যবসায় সততার অনন্য উদাহরণ।
ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশের (আইসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, সৈয়দ মঞ্জু্র এলাহী ছিলেন নৈতিক ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম। এ সময় তিনি মঞ্জুর এলাহীর সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সম্পর্ক ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর ছেলে সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, ‘বাবা বলতেন, শ্রদ্ধা কখনো আদায় করা যায় না— অর্জন করতে হয়।’ তিনি নিজে কলকাতায় সংখ্যালঘু ছিলেন; কিন্তু নারী, সংখ্যালঘু ও সুবিধাবঞ্চিতদের প্রতি তাঁর বিশেষ শ্রদ্ধা ছিল। সেই সঙ্গে তিনি বলতেন, কখনোই, কোনো অবস্থায় দেশ ছাড়া যাবে না।
সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর মেয়ে মুনিজে মঞ্জুর বলেন, ‘শিক্ষাজীবন শেষে যখন আমি কাজের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম, তখন বাবা (সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী) আমাকে এ বিষয়ে নিরুৎসাহিত করেন। তিনি বলেন, “দেশ আগে। আমি (বাবা) তোমাকে ভালো শিক্ষার সুযোগ করে দিয়েছি। এখন তুমি দেশে এসে দেশের জন্য তোমার সর্বোচ্চটা দেবে।”’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর পুত্রবধূ সামিয়া হকসহ পরিবারের সদস্যরা। অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ, অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ ব্যবসায়ী নেতা, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, অ্যাপেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী ৮৩ বছর বয়সে ১২ মার্চ মারা যান।