চট্টগ্রাম চেম্বারে ‘পকেট ভোট’ বাতিল চান ব্যবসায়ীরা

চট্টগ্রাম চেম্বারে ‘টাউন অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ট্রেড গ্রুপ’ ওই দুটি শ্রেণির সদস্য বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছে ‘চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজ’ নামে একটি গ্রুপ। এ নিয়ে তারা চেম্বারের প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছে। পরে চেম্বার প্রশাসক চিঠিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের কাছে পাঠিয়েছেন।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ দুটি শ্রেণি মূলত চেম্বারের নির্বাচনে ‘পকেট ভোট’ হিসেবে কাজ করে। এর মাধ্যমেই একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে চেম্বার দখল করে রেখেছিল। ২০১৩ সাল থেকে এই দুই শ্রেণি সদস্যদের থেকে পরিচালক পদের নির্বাচনে ভোট হয়নি। বিনা ভোটেই ছয়জন পরিচালক নির্বাচিত হন। ঘুরেফিরে দুই শ্রেণির গুটিকয় ব্যবসায়ীই নির্বাচিত হয়েছেন।

চট্টগ্রাম চেম্বারের ২৪ জনের পর্ষদে ১২ জন পরিচালক সাধারণ সদস্যদের ভোটে, ৬ জন সহযোগী সদস্যদের ভোটে, ৩ জন টাউন অ্যাসোসিয়েশন থেকে ও ৩ জন পরিচালক ট্রেড গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হন। এর মধ্যে শুধু একটি ভোট পেয়েও পরিচালক হওয়ার সুযোগ রয়েছে ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশন শ্রেণিতে।

চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষে আহ্বায়ক এস এম নুরুল হক গত ২২ ডিসেম্বর চেম্বার প্রশাসকের কাছে চিঠি দেন। এতে বলা হয়, সাধারণ ও সহযোগী সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন। তবে ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশনে এক যুগ ধরে কারসাজির মাধ্যমে ছয়জন পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।

ঘুরেফিরে একই গ্রুপ ও অ্যাসোসিয়েশন

চট্টগ্রাম চেম্বারের সর্বশেষ ভোট হয়েছে ২০১৩ সালে। এরপর ২৪ জন পরিচালক বিনা ভোটেই নির্বাচিত হন। ২০১৩, ২০১৯, ২০২১ ও ২০২৩ সালের নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায় ঘুরেফিরে পাঁচটি ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরাই নির্বাচিত হয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ব্যক্তি পরিবর্তন হলেও ঘুরেফিরে গুটিকয় গ্রুপ আর অ্যাসোসিয়েশনকেই বারবার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

ওই চার নির্বাচনে ট্রেড গ্রুপ থেকে চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার গ্রুপ, চট্টগ্রাম ক্ষুদ্র পাদুকা শিল্পমালিক গ্রুপ, চিটাগাং জিলা সড়ক পরিবহন মালিক গ্রুপ, চিটাগাং মিল্ক ফুড ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার গ্রুপ এবং চিটাগাং টায়ার টিউব ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার গ্রুপের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হন। অন্যদিকে টাউন অ্যাসোসিয়েশনে রাঙ্গুনিয়া, হাটহাজারী, পটিয়া ও বোয়ালখালী অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রেন্ড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধি নির্বাচিত হন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে চেম্বারের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, ১৯০৬ সালে যখন চেম্বারের যাত্রা শুরু হয়, তখন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চেম্বারে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য এই দুটি শ্রেণি রাখা হয়েছিল। তবে পরে এই দুটি শ্রেণিকে ব্যবহার করা হয় নিজেদের পছন্দের মানুষকে পর্ষদে আনতে। চেম্বারে গত সভাপতিও ট্রেড গ্রুপ থেকে নির্বাচিত হয়েছেন।

ট্রেড গ্রুপ থেকে সভাপতি

চেম্বারের সর্বশেষ পর্ষদ গত সেপ্টেম্বরে পদত্যাগ করার আগে সংগঠনটির সভাপতি ছিলেন ওমর হাজ্জাজ, যিনি চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের ছেলে। মূলত এম এ লতিফের বিরুদ্ধেই চট্টগ্রাম চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগ ব্যবসায়ীদের। ওমর হাজ্জাজ ২০১৭ সালে চেম্বারের পরিচালক ছিলেন।

এই দুই নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, দুইবারই তিনি ট্রেড গ্রুপ থেকে পরিচালক পদে নির্বাচিত হয়েছেন। চিটাগাং ডাইস অ্যান্ড কেমিক্যাল ইম্পোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করে নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স ইন্টারন্যাশনাল। দুবারই বিনা ভোটে নির্বাচিত হন তিনি।

চেম্বার সূত্রে জানা গেছে, ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশন থেকে নির্বাচনে প্রার্থী হতে মূলত ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশন থেকেই নাম পাঠানো হয়। তবে এর আগে সে গ্রুপ বা অ্যাসোসিয়েশনের ভোট, নির্বাচনপ্রক্রিয়া, সভা এবং সভার কার্যবিবরণী চেম্বারে পাঠাতে হয়।

সচেতন ব্যবসায়ী সমাজের আহ্বায়ক এস এম নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাধারণ ও সহযোগী সদস্যদের পরিচালক থেকে আড়াই থেকে চার হাজার ভোট লাগে। ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশন থেকে মাত্র ১৫–২০ ভোট পেলেই পরিচালক হওয়া যায়। এটাকে কাজে লাগিয়েই চেম্বারকে নিয়ন্ত্রণ করা হতো। আমরা চাই, সুষ্ঠু ও যোগ্য ব্যবসায়ীরা সুযোগ পান।’

মে মাসের শেষে নির্বাচন

এদিকে এক দশকের বেশি সময় পর চট্টগ্রাম চেম্বারে আবার নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। প্রশাসক বসার পর থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে সদস্য তথা ভোটার হওয়ার জন্য আবেদন করছেন। গত সাড়ে তিন মাসে নতুন সদস্য হয়েছেন চার হাজারে বেশি। তাঁদের আশা, সুষ্ঠু ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ভোটের আয়োজন করবেন চেম্বারের বর্তমান প্রশাসক।

সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় চেম্বার প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে তাঁদের দাবিগুলো শোনা হচ্ছে। আমরা আশা করছি, দুই ঈদের মাঝামাঝি সময়ে মে মাসের শেষের দিকে চেম্বারের নির্বাচন আয়োজন করা যাবে।’

ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশন শ্রেণি দুটো আরও আগেই বাতিল করা উচিত ছিল বলে মনে করেন চেম্বারের সাবেক সভাপতি আমির হ‌ুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা চেম্বারসহ দেশের অনেক চেম্বারে এই শ্রেণি দুটো নেই। দেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী চেম্বার হিসেবে চট্টগ্রাম চেম্বারের এ দুটো গ্রুপ আগেই বাদ দেওয়া উচিত ছিল।

আমির হুমায়ূন মাহমুদ চৌধুরী বলেন, চেম্বারে ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু নির্বাচন প্রয়োজন। তার আগে এ ধরনের শ্রেণিগুলো বাদ দেওয়া দরকার। কারণ, এসবের আড়ালে চেম্বারে ছয় পরিচালক পদে আগে থেকে নিজেদের মানুষ বসিয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকে।