ব্যবসার সনদ নবায়নে বাড়তি অর্থ দিতে হচ্ছে
ব্যবসার জন্য প্রয়োজনীয় লাইসেন্স (সনদ) নবায়নে সরকার নির্ধারিত মাশুলের চেয়ে ছয় গুণ পর্যন্ত বেশি অর্থ দিতে হয় দেশের তৈরি পোশাকশিল্পের ব্যবসায়ীদের। ঢাকায় যেকোনো ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে বাড়তি ৫-৯ হাজার টাকা দিতে হয়। জটিলতা এড়াতে অনেক সময় ব্যবসায়ীরা তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নেন। এতে ব্যবসার খরচ আরও বেড়ে যায়।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। রাজধানীর মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার আয়োজিত ‘ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কিত বাধা ও সম্ভাব্য সমাধান’ শীর্ষক সেমিনারে এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। এফবিসিসিআই, সিপিডি ও জার্মান উন্নয়ন সংস্থা (জিআইজেড) এই সেমিনারের আয়োজন করে। সেমিনারে ব্যবসায়ী নেতারা বলেছেন, ব্যবসার খরচ বাড়ছে। এতে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে।
পাঁচটি বাণিজ্য সংগঠন এফবিসিসিআই, তৈরি পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, ট্যানারিমালিকদের সংগঠন বিটিএ, রাসায়নিক শিল্পমালিক সমিতি ও প্লাস্টিক পণ্য শিল্পমালিকদের সংগঠন বিপিজিএমইএ এবং বাণিজ্যিক ব্যাংক ও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে গবেষণাটি করেছে সিপিডি।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, বয়লারের লাইসেন্স নবায়নে সরকার নির্ধারিত মাশুলের চেয়ে ৬৪৪ শতাংশ বাড়তি অর্থ দিতে হয় ব্যবসায়ীদের। শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বন্ডের লাইসেন্স নবায়নে ২৬১ শতাংশ বেশি অর্থ খরচ হয়। এ ছাড়া ট্রেড লাইসেন্সে ১৬ শতাংশ, ফায়ার লাইসেন্সে ১১৪ এবং আমদানি ও রপ্তানি নিবন্ধন লাইসেন্সের ক্ষেত্রে ১২ শতাংশ বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয় ব্যবসায়ীদের।
সেমিনারে ‘বাংলাদেশে ব্যবসায় আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রক্রিয়াগত জটিলতা: পুনর্বিন্যাস পন্থা’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ঢাকা সিটি করপোরেশনে যেকোনো ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স নবায়ন করতে নির্ধারিত মাশুলের তুলনায় ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা বেশি দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, উচ্চ মাত্রার দুর্নীতি সব ধরনের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শতভাগ বড় কোম্পানি, ৬৮ শতাংশ মধ্যম আকারের কোম্পানি এবং ৬২ শতাংশ ছোট ও ক্ষুদ্র কোম্পানি দুর্নীতিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে মনে করে। ৫৯ শতাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, সরকারি কাজের চুক্তি ও লাইসেন্স নিতে ঘুষ দিতে হয়।
ব্যবসার প্রয়োজনীয় অনুমোদন, লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নের দীর্ঘসূত্রতা এবং জটিলতা হ্রাস করতে পুরো প্রক্রিয়া ডিজিটাল করার পরামর্শ দেন খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, একেক সংস্থা থেকে লাইসেন্স নিতে একই ধরনের কাগজপত্র বারবার দিতে হয়। অনলাইনে একটি সমন্বিত প্ল্যাটফর্মে কোম্পানির সব কাগজপত্র থাকলে সংস্থাগুলো প্রয়োজনমতো যাচাই করে নিতে পারে। এতে প্রক্রিয়াটি সহজ হয়। ভ্যাট ও করব্যবস্থা নিয়ে ব্যবসায়ীদের অনেক অভিযোগ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) পুরোপুরি ডিজিটাল করা গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা যাতে সহজে ব্যবসা করতে পারেন, সেই প্রক্রিয়া সহজ করতে কাজ করছে সরকার। সরকার রপ্তানির পাশাপাশি আমদানিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে। আমদানির ক্ষেত্রে আমরা একটি দেশের ওপর নির্ভর করব না। পণ্য রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণের পাশাপাশি আমদানিতে বাজার বৈচিত্র্য আনা হবে।’
ব্যবসার খরচ বাড়ছে
সেমিনারে স্বাগত বক্তব্যে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্ক ও অশুল্ক বাধার পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও ব্যবসায়ীদের নানাবিধ প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বাধার সম্মুখীন হতে হয়।
বিদ্যমান আইনের জটিলতা, লাইসেন্স প্রাপ্তি ও নবায়নে দীর্ঘসূত্রতা, শুল্কায়ন জটিলতা, অস্থিতিশীল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে ব্যবসায়ীদের পক্ষে স্বাভাবিকভাবে ব্যবসা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি। তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হলে করব্যবস্থার জটিলতা ও হয়রানি থেকে ব্যবসায়ীদের মুক্তি দিতে হবে। ওয়ান–স্টপ সার্ভিস বা এক দরজায় সেবার আওতা বাড়ানো গেলে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়বে।
প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের চেয়ারম্যান আহসান খান চৌধুরী বলেন, ‘দেশের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। এখন আমাদের রপ্তানি বাড়াতে আঞ্চলিক সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। জার্মানি-ভারতসহ অন্যান্য দেশে ব্যবসা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে।’
শিল্পকারখানায় উন্নত কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার ওপর জোর দেন জিআইজেড বাংলাদেশের ক্লাস্টার কো-অর্ডিনেটর ওয়ের্নার ল্যাঞ্জ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের শিল্পকারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থায় ঘাটতি রয়েছে। এখানে আরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। তাহলে আরও বেশি বিদেশি বিনিয়োগ আসবে। সুশাসনে জোর দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, নামে-বেনামে বিভিন্ন মাশুল আদায়—এগুলো বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে জার্মানির ব্যবসায়ীদের কাছে বড় উদ্বেগ হয়ে উঠেছে বলে মন্তব্য করেন ঢাকায় জার্মানির দূতাবাসের উপপ্রধান জ্যান জ্যানওসকি। তিনি বলেন, বাংলাদেশে অনেক মেধাবী কর্মশক্তি থাকলেও জার্মানির বিনিয়োগকারীদের জন্য দেশটি এখনো ততটা আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি।
জ্যান জ্যানওসকি আরও বলেন, ভূরাজনৈতিক উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে জার্মানির অনেক ব্যবসায়ী চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেক কোম্পানি নতুন কেন্দ্র খুঁজছে; চীন থেকে সরে আসতে চাচ্ছে। জার্মানির বিনিয়োগকারীরা মূলত ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে তেমন একটা অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। তবে গত দুই বছরে জার্মানির বিনিয়োগ ও ব্যবসা ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে জানান তিনি।
সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন মিয়া, বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের সাবেক সদস্য মোস্তফা আবিদ খান, সাবেক কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী প্রমুখ।