শিল্প খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার সম্ভাব্য ক্ষতি: এমসিসিআই

দেশের বিভিন্ন শিল্পকারখানায় প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে শ্রমিক অসন্তোষ চলছে। আন্দোলনের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। এতে ব্যাহত হয়েছে উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম। তবে আজ রোববার পরিস্থিতি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।

তবে গত তিন সপ্তাহের শ্রমিক আন্দোলনের কারণে শিল্প খাতে আনুমানিক পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের সংগঠন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই)।

আজ রোববার রাজধানীর গুলশানে এমসিসিআইয়ের কার্যালয়ে গত আগস্ট মাসের পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স বা সূচক (পিএমআই) প্রকাশ অনুষ্ঠানে সংগঠনটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ফারুক আহমেদ এ তথ্য জানান। এ সময় এমসিসিআইয়ের পরিচালক সৈয়দ তারেক মোহাম্মদ আলী ও পলিসি এক্সচেঞ্জের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক হাসনাত আলম উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে এমসিসিআইয়ের সিইও ফারুক আহমেদ বলেন, ‘নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর থেকেই দেশের বিভিন্ন শিল্প এলাকায় শ্রমিকেরা আন্দোলন শুরু করেন। আমরা জানতে পেরেছি সারা দেশে শতাধিক কারখানায় হামলা হয়েছে। দুই শতাধিক কারখানা বন্ধ রাখতে হয়েছে। এতে সব মিলিয়ে শিল্প খাতে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়ে থাকতে পারে।’

ফারুক আহমেদ জানান, আর্থিক ক্ষতির এই হিসাব কোনো সুনির্দিষ্ট জরিপের মাধ্যমে করা হয়নি; বরং শীর্ষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে একটি অনুমিত হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে। প্রকৃত আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এর চেয়ে বেশিও হতে পারে।

দেশের অর্থনীতি এখনো সংকোচনমূলক অবস্থায় রয়েছে বলে জানায় এমসিসিআই। সংগঠনটির পক্ষ থেকে বলা হয়, বর্তমানে শিল্প খাতে অস্থিরতা চলছে। দ্রুততম সময়ে এটি কমানো না গেলে শিগগিরই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। এ জন্য শ্রমিক, মালিক, অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মিলিয়ে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে এমসিসিআইয়ের সিইও ফারুক আহমেদ বলেন, ‘আমরা যৌক্তিক আন্দোলনের মাধ্যমে বিভিন্ন ন্যায্য দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন করার পক্ষে। আমরা আশা করছি, শিল্পমালিকেরা বিষয়টা বিবেচনা করবেন। সেই সঙ্গে যাঁরা আন্দোলন করছেন, তাঁরাও ধৈর্য সহকারে এসব বিষয় বিবেচনা করবেন।’

আগস্টেও অর্থনীতির সূচক সংকোচনমূলক

এদিকে জুলাই মাসে রেকর্ড সংকোচনের পর গত আগস্ট মাসে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জের তৈরি সর্বশেষ আগস্ট মাসের পারচেজিং ম্যানেজার্স ইনডেক্স তথা পিএমআই সূচক ৬ দশমিক ৬ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ দশমিক ৫ পয়েন্ট। আন্দোলনের কারণে জুলাই মাসে সূচক ২৭ পয়েন্ট কমে ৩৬ দশমিক ৯ পয়েন্টে নেমে যায়। গত জুন মাসে পিএমআই সূচক ছিল ৬৩ দশমিক ৯ পয়েন্ট।

এমসিসিআই বলছে, জুলাই ও আগস্ট মাসে টানা আন্দোলন এবং সহিংস পরিস্থিতির কারণে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাপকভাবে বিঘ্ন ঘটে। এতে কৃষি, উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবা—এই চার খাতেই পরিস্থিতির অবনমন ঘটে।

ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেশ ত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। এরপর ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছুদিন পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকে। এ কারণে জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে পিএমআই সূচক কিছুটা বেড়েছে বলে মনে করে এমসিসিআই। কিন্তু আগস্টের শেষ দিকে এসে আবার শ্রমিক বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং দেশের বেশ কয়েকটি জেলায় বন্যা হয়। এ কারণে পিএমআই সূচক প্রত্যাশিত হারে বাড়েনি।

দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিস্থিতি নিয়ে সমীক্ষাভিত্তিক সূচক হচ্ছে পিএমআই সূচক। বিশ্বের ৮০টির বেশি দেশে পিএমআই সূচক প্রকাশের প্রথা চালু রয়েছে। সাধারণত কোম্পানির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নির্বাহীদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতি মাসে এ সূচক প্রকাশ করা হয়। হিসাব গণনা করা হয় আগের মাসের সঙ্গে তুলনা করে। ফলে তাতে বাজারের বাস্তবতা ও অর্থনীতির সম্প্রসারণ বা সংকোচনসহ নানা বিষয় উঠে আসে।

কৃষি, নির্মাণ, উৎপাদন ও পরিষেবা—এই চার খাতের ৫০০টির বেশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের মতামতের ভিত্তিতে পিএমআই সূচক প্রকাশ করা হয়। পিএমআই সূচকটি শূন্য থেকে ১০০ নম্বরের মধ্যে পরিমাপ করা হয়। স্কোর ৫০-এর বেশি হলে অর্থনীতির সম্প্রসারণ এবং স্কোর ৫০-এর নিচে হলে সংকোচন বোঝায়। আর স্কোর ৫০ থাকলে বুঝতে হবে সংশ্লিষ্ট খাতে ওই মাসে কোনো পরিবর্তন হয়নি।

গত মে মাসে বাংলাদেশের পিএমআই সূচক বেড়ে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে উন্নীত হয়। ওই মাসে সূচকটি ৭০ দশমিক ১ পয়েন্টে ওঠে। মে মাসে দেশের অর্থনীতির প্রধান চার খাত—কৃষি, ম্যানুফ্যাকচারিং বা উৎপাদন, নির্মাণ ও সেবায় সম্প্রসারণ হয়েছিল।

সর্বশেষ খাতভিত্তিক পিএমআই সূচক

আগস্টে দেশের কৃষি খাতের পিএমআই সূচকের মান ছিল ৩৮ দশমিক ৭, যা আগের মাস জুলাইয়ের ৩৫ দশমিক ৪ পয়েন্টের চেয়ে ৩ দশমিক ৩ পয়েন্ট বেশি। আগস্টে উৎপাদন খাতের পিএমআই মান ছিল ৪৭ দশমিক ৭, যা আগের মাসে ছিল ৩৪ দশমিক ১। অর্থাৎ জুলাইয়ে এ খাতে পয়েন্ট বেড়েছে প্রায় ১৩ দশমিক ৬ পয়েন্ট।

এ ছাড়া আগস্টে নির্মাণ ও সেবা খাতের পিএমআই সূচক কমে হয় যথাক্রমে ৪০ ও ৪৩ দশমিক ২ পয়েন্ট। আগের মাস জুলাইয়ে সূচক দুটির মান ছিল যথাক্রমে ৪৫ ও ৩৭ পয়েন্ট। সেই হিসাবে দেখা যাচ্ছে, আগস্টে নির্মাণ খাতের সূচক ৫ পয়েন্ট কমেছে এবং সেবা খাতের সূচক ৬ দশমিক ২ পয়েন্ট বেড়েছে।

জুলাইয়ের তুলনায় আগস্টে নির্মাণ খাতের পিএমআই সূচক কমার কারণ হিসেবে এমসিসিআই বলেছে, আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দুই মাস সরকারি প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানগুলো নির্মাণকাজে অনেক ধীর গতিতে এগোচ্ছে। এতে সার্বিকভাবে আগস্টে নির্মাণ খাতে পিএমআই সূচক কমেছে।