দই ও মিষ্টি কারখানা বন্ধ, বগুড়ায় দুগ্ধশিল্পে অর্ধশত কোটি টাকার ক্ষতি

  • ক্রেতা না থাকা বগুড়ার শেরপুরে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকায়।

  • বগুড়ায় প্রতিদিন গড়ে চার কোটি টাকার দই বিক্রি হয়।

  • এ জেলায় ছোট-বড় ৪০০ দইয়ের কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র রয়েছে।

কারফিউর কারণে বগুড়ার জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য) স্বীকৃতি পাওয়া দইয়ের ব্যবসায় দিনে চার কোটি টাকার বেশি আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে এ খাতের ব্যবসায়ীদের। দই উৎপাদন ও বেচাবিক্রি বন্ধ থাকায় এই লোকসান গুনতে হচ্ছে দই উৎপাদক ও ব্যবসায়ীদের। তাতে গত আট দিনে এ খাতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৩২ কোটি টাকা।

এ ছাড়া দই ও মিষ্টি উৎপাদন বন্ধ থাকায় দৈনিক ৪ লাখ লিটার অবিক্রীত দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন দুগ্ধ উৎপাদনকারী খামারিরা। প্রতি লিটার দুধের দাম ৭০ টাকা হিসাবে খামারিদের দৈনিক লোকসান প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। তাতে আট দিনে খামারিদের লোকসান দাঁড়ায় প্রায় ২২ কোটি টাকার বেশি।

দইয়ের রাজধানীখ্যাত বগুড়া শহরের সাতমাথায় অবস্থিত রফাত দই ঘর, চিনিপাতা, মহরম দই ঘর, শেরপুর দই ঘর, কবি নজরুল ইসলাম সড়কের প্রসিদ্ধ এশিয়া সুইটস, আকবরিয়া এক্সক্লুসিভ সুইটস, শ্যামলী সুইটস, আকবরিয়া গ্র্যান্ড হোটেলসহ প্রায় সব কটি বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ ছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত মঙ্গলবার (১৬ জুলাই) বগুড়ার সাতমাথায় সহিংসতা শুরু হলে বন্ধ করে দেওয়া হয় এশিয়া সুইটসের বিক্রয়কেন্দ্রটি। এরপর একে একে বন্ধ হয়ে যায় অন্যান্য বিক্রয়কেন্দ্রও।

বগুড়া চেম্বারের পরিচালক ও আকবরিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান আলী আলাল প্রথম আলোকে বলেন, বগুড়া শহর এবং শেরপুর উপজেলাসহ জেলাজুড়ে দই উৎপাদনকারী ছোট-বড় ৪০০টি কারখানা এবং ৫০০টি বিক্রয়কেন্দ্র আছে। জেলায় দৈনিক দই বিক্রি হয় প্রায় ৩ কোটি ৭৫ লাখ টাকার। এর বাইরে অনেক কারখানা থেকে প্রতিদিন দই যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ দেশের বড় বড় শহরে। সব মিলিয়ে দৈনিক চার কোটি টাকার দইয়ের ব্যবসা হয় বগুড়া জেলায়। সব মিলিয়ে দই ব্যবসায় গত আট দিনে প্রায় ৩২ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

এশিয়া সুইটসের ব্যবস্থাপক মো. আরিফ-উজ্জামান বলেন, ‘আমাদের কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্রে দৈনিক ১৫০ জন কারিগর ও কর্মচারী কাজ করেন। শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া সহিংসতায় ১৬ জুলাই থেকে এশিয়া সুইটসের বিক্রয়কেন্দ্র এবং কারখানা বন্ধ। ব্যবসা বন্ধ থাকলেও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও খাবারের খরচ বাবদ মোটা অঙ্কের অর্থ খরচ হয়েছে।

রফাত দই ঘরের ব্যবস্থাপনা পরিচালক দুলাল হোসেন জানান, তাঁর কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র এক দিন বন্ধ থাকলে ৩০ হাজার টাকার লোকসান গুনতে হয়।

দই তৈরির কারিগর ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম ওজনের এক সরা দই তৈরিতে দেড় থেকে পৌনে ২ লিটার দুধ লাগে। সেই হিসাবে দৈনিক ১ লাখ ২৫ হাজার সরা দই উৎপাদনে দুধ লাগে প্রায় ২ লাখ লিটার। এর বাইরে মিষ্টি উৎপাদনের জন্য দৈনিক আরও ২ লাখ লিটার দুধ সরবরাহ করা হয় কারখানায়। দই ও মিষ্টি কারখানা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন গড়ে ১ লাখ লিটার দুধ অবিক্রীত থাকছে। এসব দুধের বাজারমূল্য গড়ে ২ কোটি ৮০ লাখ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আট দিনে খামারিদের ক্ষতি ২২ কোটি টাকার বেশি।

বগুড়া চেম্বারের পরিচালক মাফুজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দইয়ের রাজধানী বগুড়ায় কয়েক শ কারখানা ও বিক্রয়কেন্দ্র আছে। এসব কারখানার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা দুগ্ধ খামারে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে দই ব্যবসায়ী ও দুগ্ধ খামারিরা বড় লোকসানে পড়েছে।

বগুড়া জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা আনিসুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, জেলায় দৈনিক প্রায় ১৮ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন করা হয়। এসব দুধের বড় অংশ দই ও মিষ্টি কারখানায় বিক্রি হয়। চলমান পরিস্থিতিতে বিক্রি না হওয়ায় দুধ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন খামারিরা।

এদিকে বগুড়ার শেরপুর প্রতিনিধি জানান, গতকাল মঙ্গলবার এই উপজেলার দুধের বাজারে প্রতি লিটার দুধের দাম ছিল ৩০ থেকে ৩২ টাকা। উপজেলার বাইরে থেকে কোনো ক্রেতা আসছে না। আবার স্থানীয় দইয়ের কারখানাগুলোও দুধ কিনছে না। এ কারণে দুধের দাম পড়ে গেছে। শেরপুর উপজেলায় দই ও মিষ্টি তৈরির ২৫০টি কারখানা রয়েছে।

উপজেলার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রেহানা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলায় বিভিন্ন খামারে প্রতিদিন ১ লাখ ৬০ হাজার লিটার দুধ উৎপাদিত হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্রেতা না থাকায় দাম পাচ্ছেন না খামারিরা। এতে খামারিরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন।

গতকাল উপজেলার জলযোগ প্লাস দই ও মিষ্টি বিক্রির শোরুমে গিয়ে দেখা যায়, দোকান মালিক পরিমল বসাক ক্রেতার অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্তু ক্রেতা নেই। পরিমল বসাক বলেন, বগুড়ার দই জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার পর শেরপুরের দই বিক্রিও বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। দূরপাল্লার যানবাহন চলাচলও বন্ধ। এ কারণে বিক্রি প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে। এখন যে বিক্রি হচ্ছে, তাতে কর্মচারীদের বেতনও হচ্ছে না।

শেরপুরে উত্তর সাহাপাড়ার শিশুপার্ক চত্বরে সবচেয়ে বড় দুধের বাজার। এই বাজারে গতকাল দুধ বিক্রির জন্য এসেছিলেন আম্বিয়া খাতুন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ক্রেতা না থাকায় অনেকেই দামও বলছে না।

উপজেলার চৌবাড়িয়া গ্রামের আবদুল লতিফ বলেন, আন্দোলনের আগে তিনি প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করেছেন ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। গতকাল সেই দুধ বিক্রি হয় ৩০ থেকে ৩৫ টাকায়। প্রতিদিন তিনি দুধ বিক্রি করেন ৩০০ থেকে ৩৫০ লিটার। এখন দুধ বিক্রি করে গোখাদ্যের দামও হচ্ছে না।