দুই সংকটে বড় সমস্যায় দেশের সিরামিক খাত
ডলার ও গ্যাস—এই দুই সংকটে চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে দেশের সিরামিক খাত। ডলার-সংকটে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খুলতে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে সিরামিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। অন্যদিকে গ্যাস-সংকটে অধিকাংশ কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এতে পণ্যের উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে।
সিরামিক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সিরামিক পণ্যের ৯০ শতাংশ কাঁচামালই আমদানিনির্ভর। ডলার ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে গ্যাস-সংকটের কারণে গত শীত মৌসুমে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী টাইলস উৎপাদন করা যায়নি। আর ডলার-সংকটে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতে ব্যাংকে ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে উদ্যোক্তাদের।
বাংলাদেশ সিরামিক উৎপাদক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিসিএমইএ) তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে সিরামিক পণ্যের বাজার ৭ হাজার ২৪৮ কোটি টাকার। তার মধ্যে শুধু টাইলসের বাজার ৫ হাজার ২১৯ কোটি টাকার। এর বাইরে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি টাকার স্যানিটারিওয়্যার এবং ৬৭২ কোটি টাকার তৈজসপত্রের বাজার রয়েছে। সার্বিকভাবে সিরামিক খাতের মোট বাজারের ৮১ শতাংশ এখন দেশীয় কোম্পানির দখলে। বাকিটা আমদানি হয়।
বর্তমানে সিরামিক খাতে মোট কারখানা রয়েছে ৭০টি। এর মধ্যে ৩২টি টাইলসের, ২০টি তৈজসপত্রের ও ১৮টি স্যানিটারিওয়্যারের কারখানা। এসব কারখানায় মোট বিনিয়োগের পরিমাণ ১৩ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা।
ময়মনসিংহের ভালুকার সিডস্টোর এলাকায় রয়েছে হালিম গ্রুপের এক্সিলেন্ট সিরামিক ও এক্সিলেন্ট টাইলস কারখানা। গ্যাস-সংকটের কারণে গত আগস্ট থেকে কারখানা দুটির উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। ডিসেম্বরে সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। প্রায় আড়াই মাস কারখানার উৎপাদন দিনে ১২ ঘণ্টা বন্ধ ছিল। বর্তমানে গ্যাস পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। তারপরও সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পাঁচ-ছয় ঘণ্টা গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন বন্ধ থাকছে। তাতে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৬০-৭০ শতাংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে।
এক্সিলেন্ট টাইলসের মহাব্যবস্থাপক (প্ল্যান্ট) মো. শামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গত ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কঠিন সময় গেছে। তখন গ্যাস-সংকটে কারখানার উৎপাদন সক্ষমতার ৩৫-৪০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করা যায়নি। অথচ তখনো বাজারে টাইলসের চাহিদা ভালো ছিল। বর্তমানে গ্যাস পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও বিক্রি কমে গেছে। তাতে গুদামে পণ্য জমছে।
এদিকে ডলার-সংকটে ঋণপত্র (এলসি) খোলা কঠিন হওয়ায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাস জুলাই-এপ্রিলে সিরামিক পণ্যের প্রধান কাঁচামাল খনিজ মাটি—চায়না ক্লে ও বল ক্লের আমদানি কমেছে সাড়ে ১৬ শতাংশ। এই সময়ে আমদানি হয়েছে ৯ লাখ ৮৬ হাজার ৪৭৬ টন খনিজ মাটি। আর গত বছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানি হয়েছিল ১১ লাখ ৮১ হাজার ৪০৪ টন খনিজ মাটি।
২০০৫ সালে গাজীপুরে টাইলস কারখানা স্থাপন করে গ্রেটওয়াল সিরামিক। এই কারখানায় ছয়টি লাইনে দিনে ৫৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এ ছাড়া হবিগঞ্জে তাদের চারু সিরামিক নামের কারখানার উৎপাদন সক্ষমতা বছরে ৮ লাখ পিস স্যানিটারিওয়্যার।
জানতে চাইলে গ্রেটওয়াল সিরামিকসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে কাঁচামাল আমদানিতে ঋণপত্র ২ দিনে খোলা যেত। বর্তমানে ১৫ দিন লাগছে। কোনো কোনো ব্যাংক তো ডলার-সংকট দেখিয়ে ঋণপত্র খুলছে না। ঋণপত্র খুলতে না পারায় মাঝেমধ্যে কারাখানায় কাঁচামালের সংকট তৈরি হচ্ছে। আমাদের এক-দুবার উৎপাদন বন্ধও হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘গ্যাস-সংকটের কারণে উৎপাদন ৩০ শতাংশ কম হচ্ছে। বেশি দাম দিয়েও আমরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছি না।’
সার্বিক বিষয়ে বিসিএমইএর সভাপতি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে সিরামিক খাতের বড় দুই সমস্যা হচ্ছে গ্যাস ও ডলার-সংকট। আমরা বাড়তি দাম দিয়েও নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাচ্ছি না। সিরামিক খাতের বেশির ভাগ কারখানা গাজীপুরে। গ্যাস-সংকটের কারণে এখানকার কারখানার উৎপাদন ৪০-৫০ শতাংশে নেমে গেছে। আবার ভোলা ও হবিগঞ্জে গ্যাস পরিস্থিতি কিছুটা ভালো থাকলেও নরসিংদী ও রূপগঞ্জে সমস্যা হচ্ছে। এ ছাড়া ডলার-সংকটের কারণে উদ্যোক্তারা ঋণপত্র খুলতে পারছেন না।’
সিরাজুল ইসলাম মোল্লা আরও বলেন, ‘সব মিলিয়ে সিরামিক খাত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে উদ্যোক্তাদের স্বস্তি দিতে টাইলস উৎপাদনে ১৫ শতাংশ ও স্যানিটারি পণ্যে ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা দরকার। তা ছাড়া আমদানি করা খনিজ মাটিতে আর্দ্রতার কারণে ৩৫ শতাংশ বাদ দিয়ে শুল্কায়ন করার দাবি করছি। কারণ, উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় এই অংশ অপচয় হয়।’