হাজার টাকার বাদামের আমদানিমূল্য ১৯৬ টাকা

কাজুবাদাম

খুচরা বাজারে তুরস্কের মেডজুল খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকায়। অথচ এ খেজুর আমদানি হচ্ছে সর্বনিম্ন ১০৬ থেকে ২৬৫ টাকায়। আবার প্রতি কেজি এক হাজার টাকার বেশি দামে বিক্রি হওয়া মরিয়ম কিংবা আজওয়া খেজুরের আমদানি দরও ১০০ থেকে ১০৬ টাকা। সাধারণ মানের খেজুর আমদানির সর্বনিম্ন দর প্রতি কেজি ১৪ থেকে ৫৩ টাকা।

খেজুরের মতো এমন অস্বাভাবিক কম দর আছে কাজুবাদামেও। ভিয়েতনাম থেকে আনা কাজুবাদামের কেনা দাম প্রতি কেজি ১২৭ থেকে ১৯৬ টাকা। কিন্তু বাজারে এই কাজুবাদাম বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি এক হাজার টাকায়।

বাজারে দামের তুলনায় এই দর দেখে নিশ্চয়ই চোখ কপালে উঠছে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, কাগজপত্রে এমন দরে এসব পণ্য বিদেশ থেকে কেনার কথা কাস্টম হাউসকে জানাচ্ছেন আমদানিকারকেরা। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ শুল্কায়নের সময় দর কিছুটা বাড়িয়ে ধরছেন।

আমদানি দর ও বাজারদরের এমন পার্থক্যের বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি নাজের হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, এমন কম দর ঘোষণা করে ব্যবসায়ীরা যেন শায়েস্তা খাঁর আমল ফিরিয়ে আনছেন। অথচ এখন যেকোনো পণ্যের আন্তর্জাতিক দর জানা যায় সহজে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চাইলে সহজেই এই ফাঁকি শনাক্ত করতে পারে।

অর্থনীতিবিদ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত শুল্ক ফাঁকি দিতে কাগজপত্রে অস্বাভাবিক কম দর ঘোষণা দিচ্ছেন আমদানিকারকেরা। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত কেনা দাম বাবদ বাকি অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে।

সম্প্রতি চট্টগ্রামের ফলমন্ডিতে জেলা প্রশাসনের অভিযানে খেজুরের আমদানি ও বাজারদরের এমন তফাতের বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর কাস্টমসে খোঁজ নিয়ে অস্বাভাবিক কম দামে খেজুর, বাদাম ও শুঁটকি আমদানির তথ্য পাওয়া যায়।

হাজার টাকার বাদাম ১৯৬ টাকায় আমদানি

দেশে যত কাজুবাদাম আমদানি হয়, তার অধিকাংশই আসে ভিয়েতনাম থেকে। ভিয়েতনাম ক্যাশো অ্যাসোসিয়েশন নিয়মিত তাদের রপ্তানির চিত্র প্রকাশ করে। সংগঠনটির হিসাবে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে তারা বাংলাদেশে প্রতি কেজি কাজুবাদাম গড়ে ৫ ডলার ৮৩ সেন্টে (প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১০৬ টাকা হিসাবে এ দাম দাঁড়ায় ৬১৭ টাকা) রপ্তানি করেছে। যদিও চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরে এই দরে একটি চালানও আমদানি হয়নি।

আরও পড়ুন

কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর চট্টগ্রামের গুলিস্তান ট্রেডিং ১ ডলার ২০ সেন্টে প্রতি কেজি কাজুবাদাম আমদানি করেছে। বাকিরা ১ ডলার ৮৫ সেন্টে আমদানি করে। কাজুবাদামের বর্তমান শুল্কহার অনুযায়ী প্রতি কেজিতে শুল্ক–কর দিতে হয় প্রায় ৬৯ টাকা। এ হিসাবে সর্বোচ্চ দরে আমদানি ধরে খরচসহ দাম পড়ছে ২৬৫ টাকা।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কাজুবাদাম রপ্তানি করে, এমন একটি কোম্পানি হলো ভিয়েতনামের প্রশি থান লং জয়েন্ট স্টক কোম্পানি। ভিয়েতনাম ক্যাশো অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কোম্পানিটি ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতি কেজি কাজুবাদাম রপ্তানি করেছে ৬ ডলার ১২ সেন্টে বা ৬৪৮ টাকা দরে। বাংলাদেশে আসার পর এই দর হয়ে যাচ্ছে ১ ডলার ৮৫ সেন্ট বা ১৯৬ টাকা। অর্থাৎ আসল দর ঘোষণা করা হলে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পেত।

জানতে চাইলে কাজুবাদাম আমদানিকারক হারুন স্টোরের কর্ণধার মো. সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যে দামে আমদানি করছি, সেই দামই ঘোষণা করছি।’

খেজুরে শুল্ক ফাঁকি

চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে তাজা খেজুর আমদানি হয় ৬৯ হাজার ৬০৮ টন। দেশের ২১৮ জন ব্যবসায়ী এই খেজুর আমদানি করেন। এসব খেজুরের গড় আমদানি মূল্য ব্যবসায়ীরা ঘোষণা দিয়েছেন ৭৫ সেন্ট বা প্রায় ৮০ টাকা। কাস্টমস শুল্কায়ন করেছে ৭৬ সেন্ট বা ৮১ টাকায়।

খেজুরের আমদানিতে শুল্ক ১০ শতাংশ। অর্থাৎ ১০০ টাকা দাম হলে শুল্ক–কর ১০ টাকা। সেই হিসাবে, কাস্টমস চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে খেজুর আমদানি থেকে রাজস্ব পেয়েছে ৬৯ কোটি টাকা। আসল দর ঘোষণা হলে এই রাজস্ব দ্বিগুণের বেশি হতো বলে কাস্টমস কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

রাজস্ব বোর্ডের তথ্য যাচাই করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ৯ মাসে প্রতি কেজি সর্বনিম্ন ১৪–১৫ সেন্টেও খেজুর আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন আমদানিকারকেরা। এতে শুল্ক–করসহ প্রতি কেজির দাম পড়ে ১৬ টাকা। এ ছাড়া ২০ সেন্ট থেকে শুরু করে ৫০ সেন্ট বা ২০ থেকে ৫৬ টাকায় খেজুর আমদানির ঘোষণা দিয়েছেন বেশির ভাগ আমদানিকারক। অথচ খুচরা বাজারে সাধারণ মানের প্রতি কেজি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ৩০০ টাকায়। এসব খেজুর কাস্টমস অবশ্য শুল্কায়ন করেছে ৫০ সেন্ট থেকে এক ডলারে।

আরও পড়ুন

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন খেজুর আমদানিকারক প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজারে এখন কম দামি খেজুরের প্রকৃত আমদানি মূল্য প্রতি কেজি ৯০ সেন্ট বা ৯৫ টাকা। দামি খেজুরের মধ্যে মরিয়ম প্রতি টন সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার ডলার, আজওয়া ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩ হাজার ২০০ ডলার ও মেডজুল সাড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার ডলারে আমদানি হচ্ছে।

সবচেয়ে বড় খেজুর আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান ঢাকার অ্যারাবিয়ান ডেটস ফ্যাক্টরি। প্রতিষ্ঠানটি মিসর থেকে মেডজুল খেজুর আমদানির দর ঘোষণা করেছে প্রতি কেজি ৯৫ থেকে ৯৮ সেন্ট। অথচ পাইকারি বাজারেই এই খেজুর ১ হাজার ৬০০ টাকার নিচে মিলছে না। অবশ্য কাস্টমস প্রতি কেজি আড়াই ডলারে শুল্কায়ন করেছে।

জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার ও বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সিরাজুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন না ধরায় তাঁর মতামত জানা যায়নি।

আরও পণ্য

খেজুর, কাজুবাদামের মতো শুঁটকি আমদানিতেও আমদানি মূল্য দেখানো হয়েছে প্রতি কেজি ৭৯ সেন্ট থেকে দেড় ডলার। তাতে প্রতি কেজির দাম দাঁড়ায় ৮৪ থেকে ১৫৯ টাকায়। অথচ বাজারে সবচেয়ে দামি লাক্ষা বা টুনা মাছের শুঁটকি বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে ছয় হাজার টাকায়। আর সাধারণ মানের বিভিন্ন ধরনের শুঁটকির দামও প্রতি কেজি ৫০০ টাকার বেশি।

জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও চট্টগ্রাম কাস্টমসের দুজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেন, শুল্ক ফাঁকি রোধে খেজুর ও কাজুবাদামে শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে যেসব পণ্যে অসংগতি পাওয়া যাবে, সেগুলোতেও শুল্কায়ন মূল্য বাড়ানো হবে।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, মূল্য কম দেখানোর বিষয়টি মূলত শুল্ক ফাঁকি দেওয়ার জন্যই। এর অর্থ, এসব পণ্য আমদানিতে বাকি টাকা ডলারে বিদেশে পাঠানো হচ্ছে। এতে ব্যবসায়ীরা বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। তাই হুন্ডির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।