আড়াই শ বছরের পুরোনো যশোর শহরে শতবর্ষী ৩ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান

প্রমত্ত ভৈরব নদের তীরে ২৫৫ বছর আগে যশোর শহরের গোড়াপত্তন হয়। ফলে শহরটিকে ঘিরে এক এক করে নানা ধরনের শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। এর মধ্যে শহরের ঐতিহ্যবাহী বড় বাজারে এখনো ব্যবসা করে চলেছে শতবর্ষী তিনটি প্রতিষ্ঠান। ধুতি-শাড়ি, প্রসাধনী, পূজার সামগ্রী, বকালসহ (ঔষধি গাছগাছড়া) বিভিন্ন পণ্য বিক্রির এই তিন দোকান এখন ইতিহাসের সাক্ষী। এগুলোর নাম নিশিবাবুর দোকান, মনসা বস্ত্রালয় ও এ রহিম ট্রেডার্স। প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালিত হচ্ছে বংশপরম্পরায়, এখন আছে তৃতীয় প্রজন্মের হাতে।

শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানা মোড় থেকে চৌরাস্তা মোড়, কাঠেরপোল ও জেল সড়ক ঘুরে আবার দড়াটানা পর্যন্ত এক বর্গকিলোমিটারের চক্রাকৃতির জায়গায় গড়ে উঠেছে বড় বাজার। এখানকার পাইকারি দোকানগুলো থেকে যশোর জেলার আটটি উপজেলার খুচরা ব্যবসায়ীরা পণ্যসামগ্রী কিনে নন। সব মিলিয়ে এই বাজারে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ কোটি টাকার পণ্য বেচাকেনা হয় বলে ব্যবসায়ীরা জানান।

বড় বাজারে একেক পণ্যের জন্য একটি করে নির্দিষ্ট পট্টি বা জায়গা রয়েছে। যেমন কাপুড়িয়া পট্টি, চুড়িপট্টি, কাঁসারিপট্টি, সোনাপট্টি ইত্যাদি। এই বাজার পণ্যভিত্তিক অন্তত ২৬টি সমিতি রয়েছে। প্রত্যেক সমিতির সদস্য ২০০ থেকে ২৫০।

প্রাচীনকালে ভৈরব নদের তীরে যশোর শহরের বড় বাজার গড়ে ওঠে। এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের অন্তত পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই বাজারের পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোয় পণ্য কিনতে আসেন।
মীর মোশারফ হোসেন, সভাপতি, বড় বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতি।

বড় বাজার ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সভাপতি মীর মোশারফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাচীনকালে ভৈরব নদের তীরে যশোর শহরের বড় বাজার গড়ে ওঠে। এক বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের অন্তত পাঁচ হাজার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই বাজারের পাইকারি ও খুচরা দোকানগুলোয় পণ্য কিনতে আসেন।’

শতবর্ষী পুরোনো নিশি বাবুর দোকানে বিভিন্ন পূজার সামগ্রী ও ঔষধী গাছগাছড়াসহ হাজার রকমের পণ্য বিক্রি হয়
ছবি– প্রথম আলো

১০৪ বছরের নিশিবাবুর দোকান

বড় বাজারের হাটখোলা সড়কের নিশিবাবুর দোকানটি বাইরে থেকে ছাপরার মতোই মনে হয়। ১০৪ বছরের পুরোনো এই দোকান দেখতে একেবারেই সাদামাটা। দোকানটিতে সনাতন ধর্মের দুর্গা–কালীসহ বিভিন্ন পূজার সামগ্রী ও বকাল জাতীয় (ঔষধি গাছগাছড়া) হাজার রকমের পণ্যের সমাহার রয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ভেজালবিহীন বকাল পণ্যের জন্য এখনো এটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান।

১৯২০ সালের দিকে নিশি নাথ মুখার্জী প্রথমে ছোট্ট একটি ছাপরায় মুদি, বকাল ও পূজার সামগ্রী বিক্রি করতে শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে নিশিবাবুর দোকানটি বড় হতে থাকে। তিনি টানা ৪৫ বছর এটি পরিচালনা করেন। ১৯৬৫ সালে ৭৫ বছর বয়সে তিনি মারা গেলে দোকানের হাল ধরেন তাঁর ছেলে সনৎ কুমার মুখার্জী। সনৎ কুমার ৩৭ বছর ব্যবসা পরিচালনার পর ২০০২ সালে মারা যান। এর আগেই অবশ্য তাঁর দুই ছেলে যদুনাথ মুখার্জী ও সঞ্জয় মুখার্জী দোকানে বসতে শুরু করেন।

দীর্ঘকাল ব্যবসায় টিকে থাকার মূলমন্ত্র কী—এমন প্রশ্নের জবাবে সঞ্জয় মুখার্জী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ আমাদের ওপরে আস্থা রেখেছেন, আর আমরাও সেই আস্থার প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করে আসছি। আমাদের কাছে বকাল পণ্যের মধ্যে অশ্বগন্ধা, ত্রিফলা, তালমাখনা, শিলাজুত, শ্বেত ও লাল চন্দন এসব পণ্য রয়েছে। এ ছাড়া পূজার সামগ্রী ও বিয়ের টোপরের ক্রেতাই বেশি। এসব পণ্যের বেশির ভাগই ভারত ও নেপাল থেকে আমদানি হয়। আমরা আনি ঢাকা ও চট্টগ্রামের আমদানিকারকদের কাছ থেকে।’

শেখ সালামত হোসেনর হাত ধরে চালু হয় এ. রহিম ট্রেডার্স। দোকানটির বয়স এখন ১১৬ বছর
ছবি– প্রথম আলো

১১৬ বছরের ব্যবসা এ রহিম ট্রেডার্স

১৯০৮ সালে ভৈরব নদের তীরে খড়ের বসতঘরের সামনের চুড়িপট্টিতে বাড়ির পাশেই তামাকজাতীয় ও খাদ্যপণ্যের একটি ছোট দোকান খোলেন শেখ সালামত হোসেন। এরপর তাঁর ছেলে শেখ আবদুর রহিম দোকানের হাল ধরেন। তিনি ৭৩ বছর ব্যবসাটি পরিচালনা করেন। ২০১০ সালে ৯৪ বছর বয়সে তিনি মারা যান। তাঁর ছেলে রফিকুল ইসলাম ১৯৯৩ সাল থেকে ব্যবসার দেখভাল করছেন।

রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১১৬ বছর ধরে আমরা সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করে আসছি। আমার দাদা সালামত হোসেন ছিলেন তামাকজাত ও খাদ্যপণ্যের খুচরা বিক্রেতা। আমার বাবা সে ব্যবসা ছেড়ে পাইকারি ও খুচরায় প্রসাধন পণ্য বিক্রি করতেন। আমি খুচরা ও পাইকারি বিক্রির পাশাপাশি পণ্য উৎপাদন ও প্যাকেজিং কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছি। আমার ছেলে কম্পিউটার সায়েন্সে লেখাপড়া করছে। সে হয়তো সফটওয়্যারের ব্যবসা শুরু করবে।’

শতবর্ষী মনসা বস্ত্রালয় ধুতি–শাড়ির জন্য যশোরের মানুষের কাছে বিখ্যাত
ছবি–প্রথম আলো

ঐতিহ্যবাহী মনসা বস্ত্রালয়

বড় বাজারের কাপুড়িয়া পট্টির মনসা বস্ত্রালয় যেন ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবেই দাঁড়িয়ে আছে। দোকানটির ছাদ এখনো সেই পুরোনো আমলের লোহার কড়ি-বর্গা দিয়ে তৈরি। দেয়ালের পিলারেও পুরোনো নকশা আঁকা রয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠা করেন গোপালগঞ্জের ব্যবসায়ী কৃষ্ণচন্দ্র সাহা। তিনি ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগেই সপরিবার যশোর এসে ব্যবসা শুরু করেন। তবে ঠিক কোন সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেছিলেন, তা তাঁর উত্তরসূরিরা বলতে পারেননি। তাঁদের ধারণা, কৃষ্ণচন্দ্র সাহা গোপালগঞ্জে কমবেশি এক শ বছর আগে এই ব্যবসা শুরু করেছিলেন।

কৃষ্ণচন্দ্রের পরে তাঁর চার ছেলে ব্যবসার হাল ধরেন। একসময় ব্যবসাসহ সম্পত্তি ভাগাভাগি হলে চিত্তরঞ্জন সাহা নামের এক ছেলে মনসা বস্ত্রালয়ের স্বত্বাধিকারী হন। চিত্তরঞ্জন ১৯৭৫ সালে মারা গেলে তাঁর দুই ছেলে চিন্ময় সাহা ও তন্ময় সাহা ব্যবসার দায়িত্ব নেন।

চিন্ময় সাহা বলেন, ‘আমার বয়স এখন ৭২ বছর। ৪৯ বছর ধরে আমরা দুই ভাই একসঙ্গে ব্যবসাটি দেখাশোনা করছি। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে মনসা বস্ত্রালয় ধুতি-শাড়ির জন্য একটি আস্থার প্রতিষ্ঠান।’

চিন্ময় সাহা ও তন্ময় সাহা যৌথ পরিবার নিয়ে সুখে আছেন। তাঁদের দুই ভাইয়ের দুজন করে চার ছেলে। এর মধ্যে একজন আমেরিকা ও একজন নিউজিল্যান্ডে থাকেন। বাকি দুজন চিকিৎসক। সুতরাং ভবিষ্যতে শতবর্ষী এই ব্যবসার হাল কে ধরবেন, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন চিন্ময়–তন্ময় দুই ভাই।