রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে ব্যবসার বড় ঝুঁকি মনে করছেন জাপানিরা
বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে সবচেয়ে বড় সমস্যা বা ঝুঁকি হিসেবে দেখছেন জাপানি বিনিয়োগকারীরা। বাংলাদেশে কাজ করা প্রায় ৯৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি এ দেশে ব্যবসার ক্ষেত্রে এই ঝুঁকিকে প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখছে। তবে এসব ঝুঁকি সত্ত্বেও সস্তা শ্রম ও বাজারসুবিধার কথা বিবেচনায় বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণের আগ্রহী ৬১ শতাংশ জাপানি কোম্পানি।
জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেট্রো) সাম্প্রতিক এক জরিপে এ মতামত তুলে ধরে জাপানি কোম্পানিগুলো। এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী জাপানি কোম্পানিগুলোর মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি করা হয়। গত বছরের আগস্ট–সেপ্টেম্বরে পরিচালিত এই জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা ১৭৫টি জাপানি কোম্পানি তাদের মতামত দিয়েছে। সম্প্রতি জরিপের এই ফলাফল জেট্রোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ২০২৪ সালে এ অঞ্চলের বেশির ভাগ দেশে জাপানি কোম্পানিগুলোর ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে এবং মুনাফারও উন্নতি হয়েছে। তবে স্থানীয় চাহিদা কমে যাওয়ায় চীন ও থাইল্যান্ডের মতো কিছু দেশে তাদের মুনাফা কমেছে। একই সঙ্গে চীনা ও স্থানীয় কোম্পানিগুলোর কারণে তারা দেশে দেশে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছে।
এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগারীয় অঞ্চলের মোট ১৩ হাজার ৭২৭টি জাপানি কোম্পানি জরিপে অংশ নেয়। তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল এ অঞ্চলে ব্যবসা সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে কোন দেশ তাদের কাছে প্রথম পছন্দের। জবাবে ভারতকে সবচেয়ে এগিয়ে রেখেছে জাপানিরা। প্রায় ৮০ শতাংশ জাপানি কোম্পানি ভারতে তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে আগ্রহী। এরপরই রয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান। জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় ৫৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, বাংলাদেশে তারা ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে আগ্রহী। যদিও এই হার গত বছরের চেয়ে কিছুটা কমেছে। এই তালিকায় বাংলাদেশের পরে রয়েছে ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইনস, তাইওয়ান ও লাওস।
সস্তা শ্রম ও বাজারসুবিধায় এগিয়ে
জরিপে জানতে চাওয়া হয়েছিল, ব্যবসার পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কোন দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। জবাবে জাপানি কোম্পানিগুলো পাঁচটি বড় সুবিধার কথা জানিয়েছে। এগুলো হচ্ছে সস্তা শ্রম, বাজার সম্ভাবনা, শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তি, ভাষাগত সুবিধা, করছাড় ও প্রণোদনা সুবিধা এবং বিশেষায়িত জনশক্তি। ৬১ দশমিক ৩ শতাংশ জাপানি কোম্পানি ‘সস্তা শ্রম’ ও বাজার সম্ভাবনার জন্য ব্যবসার পরিবেশের দিক থেকে বাংলাদেশকে শীর্ষে রেখেছে। এ ছাড়া সাধারণ শ্রমিক ও কর্মচারীর সহজপ্রাপ্তির জন্য ২৯ দশমিক ৩ শতাংশ, ভাষাগত সুবিধার জন্য ২০ শতাংশ এবং ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ কোম্পানি করছাড় ও প্রণোদনা সুবিধা এবং বিশেষায়িত জনশক্তির জন্য বাংলাদেশের ব্যবসা পরিবেশকে এগিয়ে রেখেছে।
জরিপে তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ছাড়াও সস্তা শ্রমের জন্য মায়ানমার, লাওস ও শ্রীলঙ্কাকে এগিয়ে রেখেছে জাপানি কোম্পানিগুলো। আর এ অঞ্চলে বাজারসুবিধায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ কোরিয়া। আর রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার মতো দেশকে ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য পছন্দ করেন জাপানিরা।
বড় পাঁচ ঝুঁকি
জরিপে বাংলাদেশে কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলো জানিয়েছে, এ দেশে ব্যবসা পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা। এ ছাড়া সরকারের অস্পষ্ট নীতি ব্যবস্থাপনা, বিদ্যুতের অবকাঠামোর ঘাটতি, আইনের অস্পষ্টতা ও জটিলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা—এই পাঁচ কারণ বাংলাদেশে ব্যবসা সম্প্রসারণে প্রধান ঝুঁকি।
জরিপে ৯৫ শতাংশ জাপানি কোম্পানি রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতাকে ব্যবসার পরিবেশের জন্য ঝুঁকি মনে করেছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে দেশি–বিদেশি সব মহলের ব্যবসায়ীরাই বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে ছাত্র–জনতার আন্দোলনের পর দেশে অস্থিতিশীলতা অনেক বেড়েছিল। ওই সময়েই এ জরিপ করা হয়; অর্থাৎ দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশ নিয়ে জাপানি বিনিয়োগকারীরা যে উদ্বিগ্ন রয়েছেন, সেটি জরিপে উঠে এসেছে।
মুনাফা বৃদ্ধির পূর্বাভাস
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে বাংলাদেশে কাজ করা ৫০ শতাংশ জাপানি কোম্পানির মুনাফা বাড়তে পারে। অন্যদিকে চলতি বছর আয়–ব্যয় সমান থাকবে ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ কোম্পানির এবং মুনাফা কমতে পারে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ কোম্পানির। চলতি বছর এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগারীয় দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় কাজ করা জাপানি কোম্পানিগুলো সবচেয়ে বেশি মুনাফা করবে বলে জরিপে উঠে এসেছে। এই তালিকায় শ্রীলঙ্কার পরে রয়েছে পাকিস্তান, ভারত, ফিলিপাইনস, ভিয়েতনাম ও বাংলাদেশের অবস্থান।
মুনাফা বৃদ্ধির প্রত্যাশার পাশাপাশি ব্যবসায়িক আস্থাও আগের তুলনায় বেড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৪৩ দশমিক ৫ শতাংশ কোম্পানি মনে করে, বাংলাদেশে আগের তুলনায় ব্যবসায়িক আস্থা বেড়েছে। ব্যবসায়িক আস্থা বৃদ্ধির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে শ্রীলঙ্কা।
ব্যবসায়িক পরিবেশ উপযোগী মনে করায় এ অঞ্চলের অধিকাংশ দেশেই এক–দুই বছরের মধ্যে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায় জাপানি কোম্পানিগুলো। এদিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে ভারত। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। উৎপাদন খাতে ব্যবসা করা জাপানি কোম্পানিগুলো ব্যবসা সম্প্রসারণের বিষয়ে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিকভাবেই জাপানি বিনিয়োগকারীদের এমন মন্তব্য এসেছে। গত জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় থেকে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা রয়েছে এবং নতুন সরকারের বৈদেশিক নীতিরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে। কিছু পরিবর্তন আবার বাংলাদেশে জাপানের স্বার্থের সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ফলে দুটি বিষয়ই জাপানি বিনিয়োগকারীদের কাছে অস্বস্তির কারণ, যেটি তাঁদের মতামতে উঠে এসেছে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, অবকাঠামো সংকট, দুর্নীতি প্রভৃতি কাঠামোগত সমস্যা আগে থেকেই রয়েছে। এগুলো বিনিয়োগের অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। তা সত্ত্বেও বেশির ভাগ জাপানি কোম্পানি এ দেশে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে চায়। এটি ইতিবাচক।