শ্রম অসন্তোষে লোকসানে আশুলিয়ার অনেক পোশাক কারখানা
সাভারের আশুলিয়ায় একই শিল্পমালিকের আল্পস অ্যাপারেলস ও ফ্যাশন ডটকম নামের দুটি পোশাক কারখানায় গত মাসে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে ৯ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারায় প্রতিষ্ঠান দুটিকে ৯০ লাখ টাকার মূল্যছাড় দিতে হয়েছে। হাতছাড়া হয়েছে ক্রয়াদেশও।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ফ্যাশন ডটকম ও আল্পস অ্যাপারেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খান মনিরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৯ দিন কাজ না হলেও আল্পসে শ্রমিকের মজুরি ৮৩ লাখ টাকা এবং ফ্যাশন ডটকমে ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকা দিতে হবে। এ ছাড়া আল্পসে সাড়ে ৪ কোটি টাকা ও ফ্যাশন ডটকমের ৬ কোটি টাকার ক্রয়াদেশ বাতিল হয়েছে। শ্রমিক বিক্ষোভে যে পরিমাণ লোকসান হলো, তা এক বছরে কাটিয়ে উঠতে পারব না।’
বিভিন্ন দাবিতে চলমান শ্রম অসন্তোষের কারণে সাভারের আশুলিয়ায় এক মাসের বেশি সময় ধরে অস্থিরতা চলছে। শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেওয়ার পরও পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি। এখনো কিছু কারখানায় উৎপাদন স্বাভাবিক হয়নি। মাঝে কারখানায় হামলার ঘটনাও ঘটেছে। গত মাসে দুজন পোশাকশ্রমিক মারা গেছেন।
পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে আশুলিয়ার অনেক কারখানা বড় লোকসানের মুখে পড়েছে। এমনও কারখানা আছে, যারা তিন সপ্তাহ উৎপাদন করতে পারেনি। শুধু তা–ই নয়, উৎপাদন না হওয়ায় সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ করতে না পারার উদাহরণ আছে প্রায় প্রতিটি কারখানায়। দীর্ঘ সময় ধরে অস্থিরতা চলায় নতুন ক্রয়াদেশও আগের তুলনায় কমেছে। তবে গত মাসে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বেশ কিছু কারখানা সময়মতো মজুরি দিতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে বলে জানান তাঁরা।
তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, শ্রমিক অসন্তোষে আশুলিয়ার শতাধিক কারখানা ক্ষতির মুখে পড়েছে। গত মাসে হা-মীম, শারমীন ও অনন্ত গ্রুপের কারখানাগুলোতে ১২ দিন করে উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ ছাড়া ডেকো, নাসা, মণ্ডল, নিউওয়েজ ও উইন্ডি গ্রুপের কারখানাগুলোয় ১১ দিন উৎপাদন হয়নি। এনভয় ও মেডলার গ্রুপে ১০ দিন করে, স্টারলিং গ্রুপে ৮ দিন, নিট এশিয়ায় ৭ দিন উৎপাদন ব্যাহত হয়।
ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের মালিকানাধীন রোজ ড্রেসেস লিমিটেড নামের কারখানায় শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে গত মাসে ছয় দিন কাজ হয়েছে। সাপ্তাহিক ছুটিসহ ২৪ দিন উৎপাদন বন্ধ ছিল। এ কারখানায় সাড়ে চার হাজার শ্রমিক কাজ করেন। কারখানাটিতে দিনে গড়ে ৪৫ হাজার পোশাক তৈরি হয়। এক দিন কারখানায় উৎপাদন না হলে ৪২ লাখ টাকা ক্ষতি হয়। সেই হিসাবে ২৪ দিন বন্ধ থাকায় কারখানার মোট লোকসানের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১০ কোটি টাকা। কাজ না হওয়ায় সময়মতো শিপমেন্ট দিতে পারেনি রোজ ড্রেসেস কর্তৃপক্ষ। ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি সময় চেয়ে নিয়েছে তারা। যদিও সেটি একাধিকবার পরিবর্তন করতে হচ্ছে।
রোজ ড্রেসেসের পরিচালক শাকিল মতিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে কারখানার শ্রমিকেরা ২২ দফা দাবি জানিয়ে কর্মবিরতি শুরু করে। পরে তাদের সঙ্গে আলোচনা করে ১৮ দফা মেনে নিই। মাসের মাঝামাঝি সময়ে কারখানা চালুর চেষ্টা করলে শ্রমিকেরা নতুন করে ২৫ হাজার টাকা মজুরিসহ তিন দফা দাবিতে আবার কর্মবিরতি শুরু করেন। তখন আমরা অনুসন্ধান করে দেখলাম, একটা গ্রুপ শ্রমিকদের কাজ করতে বাধা দিচ্ছে। পরে ৪২ জন শ্রমিককে সব ধরনের সার্ভিস বেনিফিট দিয়ে চাকরিচ্যুত করি। তারপর ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে আমাদের উৎপাদন স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরে।’ অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শ্রমিক বিক্ষোভের পেছনে বাইরের ইন্ধন আছে।
আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় লুসাকা গ্রুপের দুটি কারখানা রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে বেক নিট ও তামামা ডিজাইন। শ্রমিক বিক্ষোভের কারণে কারখানা দুটিতে ২০ দিনের মতো উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। তাতে দিনে ৬০-৭০ লাখ টাকার উৎপাদন কম হয়েছে। কারখানাটির উৎপাদন কার্যক্রম এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি।
লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যান হাফিজুর রহমান গত সপ্তাহে জানান, শ্রম অসন্তোষের কারণে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ না করতে পারায় ৪৮ লাখ ডলারের পণ্য নিজ খরচে উড়োজাহাজে পাঠাতে হয়েছে। ২৬ হাজার ডলার মূল্যছাড় দিতে হয়েছে এক ক্রেতাকে। গতকাল রোববার তিনি আরও বলেন, ‘অসন্তোষের কারণে দৃশ্যমান ও অদৃশ্য লোকসান হয়েছে। অদৃশ্য লোকসান হচ্ছে, আমরা ক্রয়াদেশ হারিয়েছি। কারণ, ক্রেতারা আস্থা রাখতে পারছে না।’
জানতে চাইলে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবদুল্লাহ হিল রাকিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শ্রম অসন্তোষে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, এমন অনেক কারখানা চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। সময়মতো শ্রমিকের মজুরি দিতে কারও (কারখানা) সহায়তা লাগলে তা নিয়ে আমরা কাজ করেছি। ইতিমধ্যে ৩৯টি কারখানা জানিয়েছে, তাদের মজুরি দিতে সহায়তা লাগবে। টাকার অঙ্কে যা কিনা ৬০ কোটি টাকার কাছাকাছি। ইতিমধ্যে এই কারখানাগুলোকে সহায়তা দিতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলেছি।’
অপর এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হলে শিল্পাঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ফিরে আসবে।