পণ্য পাঠানো ও নতুন ক্রয়াদেশ নিয়ে চ্যালেঞ্জে পোশাক খাত

তৈরি পোশাকশিল্প খাতছবি: প্রথম আলো

তুসুকা গ্রুপ দুই সপ্তাহে বেশ কিছু ক্রয়াদেশের বিপরীতে উৎপাদন করা তৈরি পোশাক জাহাজীকরণের জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠায়। তবে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে নির্ধারিত জাহাজে পণ্য ওঠেনি। সেই পণ্যের মধ্যে ৮০ হাজার পিস তৈরি পোশাক আবার নিজস্ব খরচে উড়োজাহাজে করে ঢাকায় পাঠাতে হয়েছে তুসুকা কর্তৃপক্ষকে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে তুসুকা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আরশাদ জামাল গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা থেকে ইউরোপের গন্তব্যে কার্গো বিমানে প্রতি কেজি তৈরি পোশাক ৫ ডলারে পাঠাতে হচ্ছে। অথচ কলকাতা থেকে কেজি প্রতি খরচ ১ ডলার ৬০ সেন্ট। শুধু তা–ই নয়, অগ্রিম অর্থ না দিলে কার্গোর গেটের ভেতরে পণ্যই নিতে দিচ্ছে না। এখন পর্যন্ত উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে।

ঢাকা থেকে ইউরোপের গন্তব্যে কার্গো বিমানে প্রতি কেজি তৈরি পোশাক ৫ ডলারে পাঠাতে হচ্ছে। অথচ কলকাতা থেকে কেজি প্রতি খরচ ১ ডলার ৬০ সেন্ট। শুধু তা–ই নয়, অগ্রিম অর্থ না দিলে কার্গোর গেটের ভেতরে পণ্যই নিতে দিচ্ছে না।
আরশাদ জামাল, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, তুসুকা গ্রুপ।

বর্তমান পরিস্থিতির কারণে সময়মতো তৈরি পোশাক জাহাজীকরণ করতে না পারায় তুসুকার মতো বেশ কিছু কোম্পানিকে নিজস্ব খরচে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে হচ্ছে। নির্ধারিত সময়ে পাঠাতে না পারায় অনেক কোম্পানিকে অবশ্য বাড়তি সময় দিচ্ছে বিদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। তবে অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আবার মূল্যছাড় দাবি করছে। এমনকি নতুন ক্রয়াদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা কিছুটা ধীরে চলো নীতি গ্রহণ করছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা।

রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতের মাঝারি ও বড় নয়জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এমন চিত্র পাওয়া গেছে। তাঁরা বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে কী পরিমাণ পণ্য উড়োজাহাজে করে পাঠাতে হবে কিংবা মূল্যছাড় দিতে হবে, সেটি বুঝতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। তবে দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। ফলে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমের জন্য প্রতিশ্রুত ক্রয়াদেশ কিছুটা কমিয়ে দিতে পারে ক্রেতারা। সেটি পরিষ্কার হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।

কোটা সংস্কার আন্দোলন ১৫ জুলাই থেকে সহিংস আকার ধারণ করে। পরে সংঘাত আরও বাড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে কারফিউ বা সান্ধ্য আইন জারি করে সরকার। ফলে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। চার দিন (১৯-২২ জুলাই) চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম বন্ধ থাকে। গত মঙ্গলবার পর্যায়ক্রমে কারখানা চালুর পাশাপাশি বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমও শুরু হয়। পরদিন বুধবার থেকে সব কারখানা আবার উৎপাদনে ফেরে।

১৯৯৮ সালে যাত্রা শুরু করা তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক হান্নান গ্রুপের কাছে স্পেনের একটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের ৭০ হাজার শার্টের ক্রয়াদেশ রয়েছে। ২৫ জুলাই সেই ক্রয়াদেশের ৩৫-৪০ হাজার শার্ট জাহাজীকরণ করার কথা ছিল। কিন্তু কারফিউর কারণে কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হয়নি। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি পণ্য রপ্তানির সময় ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ৩১-৩২ হাজার শার্ট উৎপাদন করতে হবে। হান্নান গ্রুপকে এখন বাধ্য হয়ে ৭ হাজার শার্ট নিজস্ব খরচে উড়োজাহাজে পাঠাতে হচ্ছে।

এ নিয়ে হান্নান গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ বি এম সামসুদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজে প্রতিটি শার্ট পাঠাতে ৪ ডলারের মতো খরচ হবে। তবে অন্যান্য ক্রয়াদেশের পণ্য জাহাজীকরণের সময়সীমা ক্রেতারা বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রপ্তানিকারক স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ গত দুই সপ্তাহে যেসব পণ্য জাহাজীকরণ করতে পারেনি, সেগুলো নিয়ে বিপাকে পড়েছে। ৪০ শতাংশ পণ্যে ক্রেতাদের কাছ থেকে বাড়তি সময় পেলেও বাকি ৬০ শতাংশ পণ্য উড়োজাহাজে পাঠাতে বলছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এ ক্ষেত্রে ক্রেতারা উড়োজাহাজে পাঠানোর খরচ বহন করবে। তবে এ জন্য ক্রেতারা ১৫-২০ শতাংশ মূল্যছাড় দাবি করছে।

এ বিষয়ে স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শোভন ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমরা দর–কষাকষি করছি। তারপরও হয়তো কিছু পণ্যে হলেও মূল্যছাড় দিতে হতে পারে। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত গ্রীষ্মের তুলনায় আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে ১০ শতাংশ ক্রয়াদেশ বেশি পাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সেই আশায় আপাতত গুড়ে বালি।

উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সময়মতো পণ্য জাহাজীকরণ না করায় এখনো কোনো সমস্যার মধ্যে পড়েনি নারায়ণগঞ্জের প্লামি ফ্যাশনস। তবে গত তিন কর্মদিবসে প্রতিশ্রুত যেসব ক্রয়াদেশ আসার কথা ছিল, তার মধ্যে ৩০ শতাংশ আসেনি। সেই ক্রয়াদেশ আদৌ আসবে কি না, তা নিয়ে শঙ্কায় আছে প্রতিষ্ঠানটি।

প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হক বলেন, কারফিউ এখনো তুলে নেওয়া হয়নি। তার মানে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ১০-১৫ শতাংশ ক্রয়াদেশ স্থানান্তর করতে পারে ক্রেতারা। গত কয়েক বছরে মিয়ানমার ও পাকিস্তানে যখন সমস্যা হয়েছে, তখন বাংলাদেশে ক্রয়াদেশ স্থানান্তরিত হয়েছিল। ক্রয়াদেশ পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে, সেটি বুঝতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।

বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানিতে শীর্ষ খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক। চলতি মাসের শুরুর দিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) দেওয়া পণ্য রপ্তানির হিসাবে গরমিলের বিষয়টি সামনে আনে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১৪ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি কমিটির সভার কার্যবিবরণী অনুযায়ী, তিন অর্থবছর ধরে দেশের পণ্য রপ্তানি কমেছে। বিদায়ী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৪ হাজার ২০০ কোটি ডলারের পণ্য।

এদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপটে ক্রয়াদেশ কমার আশঙ্কার কথা জানান ঊর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ। তিনি বলেন, বর্তমানে ক্রয়াদেশ আসার হার কিছুটা কম। কারণ, ক্রেতাদের মনে একধরনের শঙ্কা রয়েছে। সব মিলিয়ে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুমে ক্রয়াদেশ কিছুটা কমতে পারে। ক্রেতা সরাসরি কখনোই বলবে না, ক্রয়াদেশ দেব না। বিলম্ব করবে। একপর্যায়ে সরিয়ে নেবে।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি এস এম মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাকশিল্প এমনিতেই একটা চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এই সময়ে বড় একটা সংকটের মধ্যে পড়ে গেলাম। নতুন ক্রয়াদেশের ক্ষেত্রে একটা ধাক্কা অবশ্যই আসবে। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের আমরা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। তাদের কাছে সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। অধিকাংশ ক্রেতাই আমাদের পরিস্থিতি বুঝতে পারছে।’