মুরগির খাবারের দাম বাড়ছে
মুরগির খাবারের পাশাপাশি হাঁস, মাছ ও গবাদিপশুর খাবারের দামও বেড়েছে। তাতে প্রাণিজ আমিষের দাম আবার বাড়তে পারে।
বাজারে ফার্মের মুরগি ও ডিমের দাম কিছুটা সহনীয় অবস্থায় এসেছে। তাতে মুরগির মাংস ও ডিম কিনতে গেলে ক্রেতাদের আগের চেয়ে ব্যয় একটু কম হচ্ছে। কিন্তু বাজারে পোলট্রি খাবারের দাম আবার বাড়তে শুরু করেছে। পোলট্রি খাবারের দাম বাড়লে খামারিদের মুরগি উৎপাদনের খরচও বেড়ে যাবে। বাড়তি এই খরচ গিয়ে পড়বে ক্রেতাদের ওপর।
খামারি, মুরগির খাবারের ব্যবসায়ী ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত এক সপ্তাহে বাজারে মুরগির খাবারের দাম কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ সাড়ে তিন টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। তাতে ৫০ কেজির এক বস্তা খাবারের দাম ১৭৫ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ৩ হাজার ৪০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায় এক বস্তা পোলট্রি খাবার পাওয়া যেত, তা এখন ৩ হাজার ৫৭৫ থেকে ৩ হাজার ৬৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কিছুদিন খামারিরা ভালো ছিলেন। এখন আবার মুরগির খাবারের দাম বাড়ানো হলো। এতে খামারিদের ওপর চাপ বাড়বে। অনেকে উৎপাদন ছেড়ে দেবেন।সুমন হাওলাদার, সভাপতি, বিপিএ
মানভেদে ব্রয়লার মুরগি ও সোনালি মুরগির খাবারের দামে প্রতি বস্তায় ১০০ থেকে ১৫০ টাকার মতো পার্থক্য থাকে। ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির পাশাপাশি লেয়ার মুরগি ও হাঁসের খাবারের দাম কেজিপ্রতি সর্বনিম্ন ২ টাকা বেড়েছে।
মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাছের ও গরুর খাবারও। এই দুই পদের খাবারের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ আড়াই টাকা পর্যন্ত।
পোলট্রি খাবারের বড় উপকরণ হলো ভুট্টা ও সয়া মিল। এ ছাড়া চালের কুঁড়া, ক্যানুলা মিল, গমের আটা, সাধারণ লবণসহ অন্যান্য উপকরণের সংখ্যা ১৫ থেকে ২০টি। খাবারের মানভেদে উপাদান কমবেশি হয়। এসব উপকরণের অধিকাংশই আমদানিনির্ভর।
আমদানিকারকদের দাবি, মুদ্রাবাজারে মার্কিন ডলারের দাম নিয়ে নতুন করে অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ায় পোলট্রি খাবারের দাম বাড়ছে।
অবশ্য মুরগির খাবারের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বরাবরের মতো উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেটের দিকেই অভিযোগের তির ছোট খামারিদের। তাঁদের দাবি, এসব প্রতিষ্ঠান সময়ে-সময়ে নিজেদের মতো করে মুরগির খাবারের দাম বাড়িয়ে দেয়। এতে বিপদে পড়েন ছোট খামারিরা। সে জন্য দাম নির্ধারণে সরকারের হস্তক্ষেপ চান তাঁরা।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) সভাপতি সুমন হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, কিছুদিন খামারিরা ভালো ছিলেন। এখন আবার মুরগির খাবারের দাম বাড়ানো হলো। এতে খামারিদের ওপর চাপ বাড়বে। অনেকে উৎপাদন ছেড়ে দেবেন। তখন করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কন্ট্যাক্ট ফার্মিংয়ে যুক্ত করবে। চুক্তি অনুযায়ী ডিম-মুরগির দাম নির্ধারণেও তখন খামারিদের কোনো ভূমিকা থাকবে না। কার্যত সবাই জিম্মি হয়ে পড়বেন।
সংগঠনটি বলছে, দেশে পোলট্রি খাবার উৎপাদনে ২২০টির মতো নিবন্ধিত কোম্পানি আছে। এর মধ্যে ৫০ থেকে ৬০টি এখন উৎপাদনে আছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ কারখানা আবার পুরোপুরি উৎপাদনে নেই; অর্থাৎ এই কারখানাগুলো আংশিকভাবে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এই পরিস্থিতির জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের বাড়তি দাম ও দেশে ডলারের বাজারের অস্থিরতাকে দায়ী করছেন ফিডমিলের মালিকেরা।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব অনুযায়ী, বাজারে এখন ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি ১৬০ থেকে ১৭০ টাকা দরে। ফার্মের মুরগির ডিম বিক্রি হচ্ছে ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় হালি দামে। সোনালি মুরগির কেজি ৩০০ টাকার নিচে।
নরসিংদীর মুরগির খামারি খাজাল উদ্দিন বলেন, মুরগি ও ডিমের বর্তমান যে বাজারদর তাতে অনেক খামারি লোকসানে পড়েছেন। নতুন করে ফিডের (খাবারের) মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায়, উৎপাদন খরচ আরও বাড়বে। তখন আবার খামারিদের টিকে থাকার লড়াই শুরু হবে। বর্তমানে পোলট্রি ব্যবসা আগের মতো লাভজনক নেই, বরং ঝুঁকি বেশি।
ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম বলেন, ১২০ শতাংশ পর্যন্ত মার্জিন দিয়ে আমদানি ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হচ্ছে। এরপরও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। ডলার পেলেও চড়া দাম দিতে হচ্ছে। আগের চেয়ে বিনিয়োগ বেড়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে ভুট্টার দাম পড়ছে প্রতি টন ২৭৫ থেকে ২৮০ ডলার, যা আগের যেকোনো সময়ে চেয়ে বেশি। এই পরিস্থিতিতে দেশের সয়াবিন তেল উৎপাদনকারী কোম্পানি থেকে আসা সয়া মিলের দাম বেঁধে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ছোট-বড় মিলিয়ে মুরগির খামার আছে ৮০ হাজার থেকে ৯০ হাজার। করোনার আগে সংখ্যাটি ছিল ১ লাখ ১০ হাজারের ওপর। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে দেশে প্রতিদিন ৪ কোটির বেশি ডিম ও ৩ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদিত হয়। পোলট্রি খাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে ৬০ লাখ লোকের, আর বাজারের আকার ৪০ হাজার কোটি টাকার বেশি।