সুষ্ঠু ভোটের আশায় চট্টগ্রাম চেম্বারে নতুন সদস্য হওয়ার ধুম
১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ ভোট হয় ২০১৩ সালে।
গত ৯ সেপ্টেম্বর প্রশাসক বসার পর থেকে এ পর্যন্ত সদস্য হন ৪ হাজার ১০০ জন।
সদস্যপদ নবায়নসহ মোট সদস্যসংখ্যা ১২ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে।
সাধারণ সদস্যরা ১২টি পদে ও সহযোগী সদস্যরা আলাদা ছয়টি পদে ভোট দিতে পারেন।
এক দশকের বেশি সময় পর চট্টগ্রাম চেম্বারে আবার নির্বাচনী আবহ তৈরি হয়েছে। প্রশাসক বসার পর থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা নিয়ে সংগঠনটির সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করছেন। গত সাড়ে তিন মাসে নতুন সদস্য হয়েছেন চার হাজারে বেশি। তাঁদের আশা, নতুন বছরে সুষ্ঠু ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ভোটের আয়োজন করবেন চেম্বারের বর্তমান প্রশাসক।
চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ ভোট হয়েছিল ২০১৩ সালে। এরপর আর কোনো ভোট হয়নি। এই সময়ে আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফ নির্বাচনের নামে প্রভাব খাটিয়ে ও কারসাজি করে পছন্দের ও দলের লোকেদের ভোটার বানিয়েছেন। তাঁদের মধ্য থেকে কিছু ব্যক্তিকে নেতা বানিয়ে তিনি চেম্বারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এ নিয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগের অন্ত ছিল না। ভোটার তালিকা সুষ্ঠু না হওয়ায় আওয়ামী লীগের বাইরের কেউ নির্বাচন করেননি বা করতে পারেননি। সব নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে অনেক ব্যবসায়ী এই সংগঠনের সদস্য হতে পারেননি।
দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চেম্বারের পরিচালনা পর্ষদ পদত্যাগ করলে গত ৯ সেপ্টেম্বর সংগঠনটিতে প্রশাসক বসায় সরকার। এর পর থেকেই চেম্বারের সদস্য হওয়ার জন্য আবেদন করার হিড়িক পড়ে। সদস্য হওয়া যায় প্রতিবছর জুলাই থেকে পরের বছরের জুন পর্যন্ত। একই সময়ে আগের সদস্যদেরও সদস্যপদ নবায়ন করে নিতে হয়। ১৮টি পদের মধ্যে প্রত্যেক সাধারণ সদস্য ১২টি ও সহযোগী সদস্য ৬টি ভোট দিতে পারেন।
চেম্বার কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, ৯ সেপ্টেম্বর থেকে গত বুধবার পর্যন্ত চট্টগ্রাম চেম্বারের নতুন সদস্যপদ পেয়েছেন ৪ হাজার ১০০ ব্যক্তি। এর মধ্যে সাধারণ সদস্য ২ হাজার ৭০৩ এবং সহযোগী সদস্য ১ হাজার ৩৯৭। একই সময়ে পুরোনো সদস্যদের মধ্যে ১ হাজার ৮০ জন সাধারণ সদস্য ও ৬৯৫ সহযোগী সদস্য তাঁদের সদস্যপদ নবায়ন করেছেন। ১ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে সংগঠনটির মোট সদস্যসংখ্যা বেড়ে ১২ হাজারের কাছাকাছি পৌঁছেছে, যারা আগামী নির্বাচনে ভোট দিতে পারবে।
আমরা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় সদস্য সংগ্রহ করছি। নিয়ম অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। আগামী জুন পর্যন্ত আমার মেয়াদ। দুই ঈদের মাঝামাঝি সময়ে চেম্বারের নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে
চট্টগ্রাম চেম্বারের সহকারী সচিব (সদস্যপদ শাখা) সৈয়দ সালাওয়াত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে প্রতিবারই সদস্যসংখ্যা কিছুটা বাড়ে। তবে এতসংখ্যক নতুন সদস্য হতে আমি আগে কখনো দেখিনি।’ তিনি আরও বলেন, চেম্বারের প্রশাসকের নির্দেশনা অনুযায়ী যাচাই-বাছাই করে সদস্যপদ দেওয়া হচ্ছে।
এত সদস্য যে কারণে
২০১৩ সালে নির্বাচনের আগে চট্টগ্রাম চেম্বারে ভোটারসংখ্যা ছিল প্রায় সাত হাজার। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজারই ভুয়া ভোটার বলে অভিযোগ ছিল ব্যবসায়ীদের। এম এ লতিফ বর্তমানে কারাগারে থাকায় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য জানা যায়নি। গত এক দশকে যাঁরা ভোটার হতে পারেননি, তাঁরাই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এখন নতুন করে সদস্য হচ্ছেন বা পদটি নবায়ন করছেন।
চেম্বারে নতুন সদস্যপদ পাওয়া ১৭ জন ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা হয়েছে প্রথম আলো প্রতিনিধির। এতে জানা যায়, মূলত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলেই চেম্বারমুখী হয়েছেন অধিকাংশ ব্যবসায়ী। নতুন সদস্যদের মধ্যে খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকসহ গাড়ির যন্ত্রাংশ, শিপিং কোম্পানি, অটোমোবাইল, মেরিন সার্ভিস, জুয়েলারি শপ, রেস্তোরাঁ, আইএসপি, ফার্মেসি ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের দোকান এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায় যুক্ত ব্যবসায়ীরা সদস্য হচ্ছেন।
নতুন সদস্যদের মধ্যে চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার বণিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. ছালামত আলীও রয়েছেন। তিনি আগে কয়েকবার সদস্যপদ পেলেও মাঝখানে সদস্য হতে পারেননি। আবার কাগজে-কলমে সদস্য হয়েও ভোট দিতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘মাঝে একধরনের কোটা ভিত্তিতে চেম্বারের সদস্য নেওয়া হতো। শুধু পছন্দের মানুষদের সদস্য করা হতো। যে কারণে আমরা খোঁজখবর রাখিনি।’
চেম্বারের সদস্যপদ শাখা জানায়, নির্বাচনের ১২০ দিন আগে যাঁরা সদস্য হবেন, কেবল তাঁরাই ভোট দিতে পারবেন। এর মধ্যে নির্বাচনের ৯০ দিন আগে নির্বাচন বোর্ড ও নির্বাচন আপিল বোর্ড গঠন এবং ৮০ দিন আগে তফসিল ঘোষণা করতে হয়। চেম্বারের বর্তমান প্রশাসকের মেয়াদ আগামী বছরের জুনে শেষ হচ্ছে। তাঁর মেয়াদেই ভোট দেওয়া যাবে, এমন আশায় বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ী সদস্যপদ নিচ্ছেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে সংগঠনটির প্রশাসক ও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (সার্বিক) মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় সদস্য সংগ্রহ করছি। নিয়ম অনুযায়ী ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। জুন পর্যন্ত আমার মেয়াদ। দুই ঈদের মাঝামাঝি সময়ে চেম্বারের নির্বাচন আয়োজনের প্রাথমিক পরিকল্পনা রয়েছে।’
যেমন ছিল আগের অবস্থা
চট্টগ্রাম চেম্বারে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অভিযোগ ওঠে মূলত সংগঠনটির সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এম এ লতিফের বিরুদ্ধে। ২০০৮-০৯ সাল মেয়াদে চেম্বারের সভাপতি নির্বাচিত হয়েই তিনি চেম্বারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ শুরু করেন। নিজের পছন্দের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি আত্মীয় এবং দুই ছেলেকেও তিনি চেম্বারের পরিচালক করেন। তাঁর ছেলে ওমর হাজ্জাজ চেম্বারের গত পর্ষদের সভাপতি ছিলেন।
চট্টগ্রাম চেম্বারে সর্বশেষ ভোট হয়েছিল ২০১৩ সালের ৩০ মার্চ। ওই নির্বাচনেও এম এ লতিফ–সমর্থিত প্যানেল বিজয়ী হয়। প্রথমবারের মতো সভাপতি নির্বাচিত হন মাহবুবুল আলম। তিনি ২০১৩ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত সভাপতি ছিলেন। এই ১০ বছরে টানা পাঁচবার ভোটের বদলে এম এ লতিফের পছন্দের লোকেরাই চেম্বারের নেতা নির্বাচিত হন। এ নিয়ে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছিল।
৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর চট্টগ্রাম চেম্বার নিয়ে ব্যবসায়ীদের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ প্রতিবাদে রূপ নেয়। ফলে চেম্বারের পুরো পর্ষদ পদত্যাগে বাধ্য হয়। এটিই ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত শতবর্ষী এই চেম্বারের পুরো পর্ষদের পদত্যাগের প্রথম ঘটনা বলে জানা গেছে। লতিফপন্থী নেতাদের পদত্যাগের পর থেকে চেম্বারের নতুন ভোটার তালিকা করার দাবি জোরদার হয়।
চেম্বারের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এস এম নুরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, দীর্ঘদিন একচ্ছত্র আধিপত্য থাকায় কেউ আগ্রহ পাননি সদস্য হওয়ার। লতিফ-মাহবুব সমর্থিত ৮০ শতাংশ সমর্থক ব্যবসায়ী সদস্যপদ নবায়ন করেননি। এখন ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। আশা করা যায়, চেম্বারে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে।