মূলধনি যন্ত্রপাতি
অনিশ্চয়তায় কমে গেছে শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি
ডলার–সংকট ও অর্থনীতিতে অস্থিরতার কারণে শিল্প স্থাপনের নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের উদ্যোগ কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ডলার–সংকট ঠেকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী উদ্যোগের কারণে সব ধরনের ঋণপত্র খোলায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কড়াকড়ি আরোপ করেছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দার শঙ্কাও তীব্র হচ্ছে। সে কারণেই শিল্প স্থাপনের নতুন প্রকল্প, ব্যবসা সম্প্রসারণ ও সংস্কারের নতুন তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছেন না উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। এ কারণে গত জুলাই-আগস্টে শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারিজ) আমদানির ঋণপত্র খোলা ৬৫ শতাংশ কমে গেছে।
উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমান অস্থির সময়ে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছে না। কারণ, গ্যাস-বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে বর্তমানে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-আগস্টে শিল্পের উৎপাদনের যন্ত্রপাতি আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৪০ কোটি ডলারের, গত বছরের একই সময়ে খোলা হয়েছিল ১১৫ কোটি ডলারের ঋণপত্র। ফলে ঋণপত্র খোলা কমেছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। তবে এই সময়ে ঋণপত্র নিষ্পত্তি বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ।
গত অর্থবছরে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা হয়েছিল ৬৪৬ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি। আর ঋণপত্র নিষ্পত্তি হয়েছিল ৫২৬ কোটি ডলারের, যা আগের বছরের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আমদানির ক্ষেত্রে ৩০ লাখ ডলারের বেশি ঋণপত্র খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে বড় অঙ্কের এলসি খোলা হলে তা আটকে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আবার ডলার স্বল্পতার কারণে অনেক ব্যাংক বড় অঙ্কের ঋণপত্র খোলা বন্ধ রেখেছে বা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে ঋণপত্র খোলা কমে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘করোনা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। অনেক দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলছে। এ অবস্থায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে, তবে এটা স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। দেশীয় প্রবৃদ্ধি অবিচল রাখতে নীতি কৌশল ও প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশে আমদানি হওয়া মূলধনি যন্ত্রপাতির বড় অংশই ব্যবহৃত হয় রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে কয়েক মাস ধরে তৈরি পোশাকের নতুন ক্রয়াদেশ কম। আবার টানা ১৩ মাস পর গত সেপ্টেম্বরে পণ্য রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে নিট পোশাক মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে কারখানার বর্তমান উৎপাদন ক্ষমতাকেই কাজে লাগাতে পারছি না আমরা। ফলে ব্যবসা সম্প্রসারণের নতুন কোনো পরিকল্পনায় কেউ যাচ্ছেন না। অতি প্রয়োজনীয় হলেই কেবল মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি করছেন কেউ কেউ।’
আগামী বছরের মধ্যে অন্তত ১০টি নতুন বস্ত্রকল উৎপাদন শুরু করতে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। এতে কয়েক হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নতুন মিলগুলোর কেউ কেউ বর্তমান সংকটের আগেই মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানি ঋণপত্র খুলেছিলেন। আর যাঁরা ঋণপত্র খোলেননি, তাঁরা এখন হাত গুটিয়ে নিয়েছেন। এতে করে নতুন সব কটি কারখানা নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আসতে পারবে না। অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বস্ত্র কারখানায় গ্যাস সরবরাহের অবস্থা আগের তুলনায় আরও খারাপ হয়েছে।
এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, গত এক–দেড় বছরে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। তার প্রধান কারণ পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই উৎপাদন সক্ষমতা বাড়িয়েছিলেন। বর্তমানে রপ্তানিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধি নেই। সে কারণে ব্যবসা সম্প্রসারণ কমে আসছে। এতে করে নিকট ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা হবে না। তবে দুশ্চিন্তার বিষয়, ভবিষ্যতের বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে শিল্পের উৎপাদন, রপ্তানি ও কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি স্থবির হয়ে যেতে পারে।