কেন চামড়া রপ্তানিতে অন্তত ৫০ কোটি ডলার হারাচ্ছে বাংলাদেশ
বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ থাকতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র দুটি প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ রয়েছে। ফলে বাংলাদেশ মূলত এমন বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে, যেখানে ব্র্যান্ড মূল্য নেই। ফলে এ দেশের রপ্তানিকারকেরা পণ্যের দাম কম পান।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বাংলাদেশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার আয় হারাচ্ছে।
চামড়া খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিশ্বের বড় ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ভালো দামে চামড়াজাত পণ্য বিক্রি করতে হলে এলডব্লিউজির সনদ জরুরি। পোশাক খাতে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (ইউএসজিবিসি) লিড সনদ পোশাক কারখানাকে ক্রয়াদেশ ও ভালো দাম পেতে সহায়তা করে, তেমনি চামড়া খাতেও এলডব্লিউজির সনদ ভালো বৈশ্বিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ব্যবসা করার জন্য জরুরি।
২০০৫ সালে নাইকি, অ্যাডিডাস, টিম্বারল্যান্ডের মতো কয়েকটি বৈশ্বিক ব্র্যান্ড ও জুতা উৎপাদনকারী মিলে এলডব্লিউজি গঠন করে। পরিবেশ সুরক্ষা করে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন করার বিষয়টি নিশ্চিত করাই সংস্থাটির লক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্বে এক হাজারের বেশি ব্র্যান্ড ও সরবরাহ খাতের প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজির সদস্য।
এলডব্লিউজির ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, সংস্থাটি কারখানা নিরীক্ষার জন্য সাধারণ একটি মান কাঠামো তৈরি করে। সে অনুযায়ী নিরীক্ষা করে কারখানাগুলোকে গোল্ড, সিলভার, ব্রোঞ্জ ও সাধারণ কারখানায় শ্রেণিভুক্ত করে। কারখানা নিরীক্ষার ক্ষেত্রে তারা পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিকর রাসায়নিক বা অন্যান্য উপাদানের ব্যবস্থাপনা, বর্জ্য পরিশোধন, কাঁচামালের উৎস, জ্বালানি ও পানির ব্যবহার ইত্যাদি নানা বিষয় খতিয়ে দেখে।
দেশে পরিবেশদূষণ কমিয়ে কারখানাগুলোকে আন্তর্জাতিক মানে নিতে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো সরিয়ে সাভারের চামড়া শিল্পনগরীতে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে প্রায় ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয়ে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারও (সিইটিপি) তৈরি করা হয়। কিন্তু সিইটিপি পুরোপুরি কার্যকর না হওয়ায় ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো এলডব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না। ফলে এর প্রভাব পড়ছে সার্বিক রপ্তানিতে।
রপ্তানি আয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা জানান, বর্তমানে দেশ থেকে এলডব্লিউজি সনদবিহীন কারখানায় প্রক্রিয়াজাত প্রতিটি চামড়া ন্যূনতম ৪৫ সেন্ট থেকে শুরু করে ১ দশমিক ৬০ ডলারে রপ্তানি হচ্ছে। তবে এলডব্লিউজি সনদধারী কারখানার ক্ষেত্রে এই দর দ্বিগুণের বেশি।
দেশে এখন পর্যন্ত চামড়া খাতের দুটি প্রতিষ্ঠান এলডব্লিউজি সনদ পেয়েছে। এ ছাড়া আরেকটি প্রতিষ্ঠান সনদ পেতে নিরীক্ষার পর্যায়ে আছে।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত টি কে গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিফ লেদার কারখানা কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশিড ধাপ পর্যন্ত কাজের জন্য এলডব্লিউজি সিলভার সনদ পেয়েছে। আর রিটেনিং পর্যায় থেকে ফিনিশড চামড়া পর্যন্ত ধাপের জন্য এলডব্লিউজি গোল্ড সনদ পেয়েছে অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার। এ ছাড়া এবিসি ফুটওয়্যার ইন্ডাস্ট্রিজ নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠানকে এলডব্লিউজি সনদ দেওয়ার বিষয়ে নিরীক্ষা চলছে। চলতি বছরেই তারা এ সনদ পেতে পারে।
ট্যানারিমালিকেরা জানান, বাংলাদেশ থেকে তুলনামূলকভাবে কম দামে প্রক্রিয়াজাত বা আংশিক প্রক্রিয়াজাত চামড়া কিনে কিছুটা মূল্য সংযোজন করে পুনরায় তা বিক্রি করছে চীনসহ কয়েকটি দেশ। এসব চামড়া তারা ২ দশমিক ২৫ ডলারেও বিক্রি করে থাকে।
বিটিএ সভাপতি মো. শাহীন আহমেদ বলেন, বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের এলডব্লিউজি সনদ না থাকায় বিপুল অঙ্কের রপ্তানি আয় হারাচ্ছে দেশ। চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য মিলিয়ে বছরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানি আয় হারাচ্ছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে ইউরোপসহ অনেক দেশে জুতাসহ বিভিন্ন চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে এলডব্লিউজি সনদ পাওয়া কারখানার চামড়া ব্যবহারের শর্ত থাকে। এ কারণে বছরে প্রায় ১৫ কোটি (১৫০ মিলিয়ন) ডলারের চামড়া আমদানি করে কোম্পানিগুলো।
বিটিএর সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, দেশের ট্যানারিগুলোর এলডব্লিউজি সনদ থাকলে এই পরিমাণ চামড়া আমদানি করা লাগত না। তাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও সাশ্রয় হতো।
চামড়া খাতের অবস্থা
আয়ের দিক থেকে দেশে তৈরি পোশাক খাতের পরে দ্বিতীয় শীর্ষ রপ্তানি পণ্য হলো চামড়া। ২০২১–২২ অর্থবছরে প্রায় ১২৪ কোটি ৫২ লাখ মার্কিন ডলারের চামড়া ও চামড়া থেকে তৈরি পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু চামড়া রপ্তানি হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি ১৪ লাখ ডলারের। দেশে তৈরি চামড়ার জুতা বা পাদুকা রপ্তানি হয়েছে ৭৫ কোটি ৬২ লাখ ডলারের। আর অন্যান্য চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে ৩৩ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের।
অন্যদিকে চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের জন্য ১৪৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে গত মে মাস পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে ১১২ কোটি ডলারের চামড়া ও পণ্য।
গত ছয় বছরের রপ্তানি আয়ের তথ্যে দেখা যায়, করোনার আগে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে বছরে ১০০ কোটি ডলারের বেশি আয় হতো। তবে করোনার সময় দুই বছর রপ্তানি আয় কমে যায়। সর্বশেষ ২০২১–২২ অর্থবছর থেকে এই খাতে রপ্তানি আয় আবার ১০০ কোটি ডলারের সীমা ছাড়িয়েছে।
ইপিবির তথ্য অনুসারে, ২০১৭–১৮ অর্থবছরে ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। ২০১৮–১৯ অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১০২ কোটি ডলার। তবে করোনার দুই বছর, অর্থাৎ ২০১৯–২০ ও ২০২০–২১ অর্থবছরে রপ্তানি আয় অনেক কমে যায়। এই দুই বছরে যথাক্রমে ৮০ কোটি ও ৯৪ কোটি ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়। করোনার ধাক্কা কাটিয়ে ২০২১–২২ অর্থবছরে রপ্তানি আয় আবার বৃদ্ধি পেয়ে ১২৪ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়।
চামড়া রপ্তানি বেশি চীনে
ইপিবির চলতি অর্থবছরের রপ্তানির তথ্যে দেখা গেছে, দেশে চামড়ার বড় রপ্তানি বাজার হচ্ছে চীন। এসব চামড়া আংশিক বা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াজাত অবস্থায় রপ্তানি হয়। ২০২২–২৩ অর্থবছরের মে মাস পর্যন্ত চীনে পাঁচ কোটি ডলারের বেশি মূল্যের চামড়া রপ্তানি হয়েছে।
চামড়া রপ্তানিতে চীনের পরের অবস্থান ইতালি, স্পেন, ভিয়েতনাম, হংকং, জাপান ও ভারতের। এসব দেশে গড়ে ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের চামড়া রপ্তানি হয়। এ ছাড়া তাইওয়ান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, দক্ষিণ কোরিয়া, পর্তুগাল ও তুরস্কে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চামড়া যায় বাংলাদেশ থেকে।
পণ্য রপ্তানির মূল গন্তব্য ইইউ
ইপিবির তথ্য বলছে, দেশে তৈরি চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির দিক থেকে সবচেয়ে এগিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলো। ইইউভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয় ইতালিতে।
এ ছাড়া জাপান, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, চীন, হংকং, ফ্রান্স, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় উল্লেখযোগ্য পরিমাণে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি হয়।
চামড়ার বৈশ্বিক বাজার
ওয়ার্ল্ড ইন্টিগ্রেটেড ট্রেড সলিউশনের (ডব্লিউআইটিএস) মতে, বর্তমানে বিশ্বে কাঁচা চামড়ার রপ্তানি বাজার ১১ হাজার কোটি ডলারের বেশি। রপ্তানিতে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর চীন, সুইজারল্যান্ড, হংকং, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের অবস্থান। সবচেয়ে বেশি আমদানি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর পরে রয়েছে চীনের অবস্থান।
অন্যদিকে বেসকারি সংস্থা গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে চামড়াজাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল ২৫ হাজার ৩৮২ কোটি ডলারের। প্রতিবছরই চামড়াজাত পণ্যের বাজার বাড়ছে। ২০৩০ সাল নাগাদ এই বাজার ৪০ হাজার ৫২৮ কোটি ডলারে পৌঁছাতে পারে।
চামড়া থেকে তৈরি উপকরণ সাধারণত টেকসই হয়। প্রক্রিয়াজাত চামড়া এককভাবে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয় জুতা তৈরির কাজে। গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে মোট চামড়াজাত পণ্যের মধ্যে জুতার হিস্যা ছিল প্রায় ৪০ শতাংশ।
ওয়ার্ল্ড ফুটওয়্যারের তথ্য অনুসারে, চামড়ার জুতা রপ্তানিতে শীর্ষ দেশ চীন। মোট রপ্তানির ৬০ শতাংশ হয় চীন থেকে। দেশটি ২০২১ সালে প্রায় ৭৮৯ কোটি জোড়া চামড়ার জুতা রপ্তানি করে। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভিয়েতনাম ২০২১ সালে ১২৯ কোটি জোড়া জুতা রপ্তানি করেছে। চামড়ার জুতা রপ্তানিতে এরপর রয়েছে ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, জার্মানি, ভারত, বেলজিয়াম, ইতালি, নেদারল্যান্ডস ও কম্বোডিয়ার অবস্থান।
আর জুতা আমদানিতে শীর্ষে রয়েছে ইইউভুক্ত দেশগুলো। এ ছাড়া জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জুতা আমদানি করে থাকে।
জুতার পাশাপাশি চামড়ার নমনীয়তা, স্থায়িত্ব ও টেকসই গুণের কারণে এটিকে আসবাব, পোশাক, ব্যাগ, বেল্ট, গ্লাভস, ঘড়িসহ বিভিন্ন ফ্যাশন উপকরণ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া গাড়ি, গৃহসজ্জার সামগ্রী, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, ঘোড়া বাঁধার সামগ্রী হিসেবেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পোশাক ও খেলাধুলার (ক্রীড়া) সরঞ্জামে চামড়ার ব্যবহার বেড়েছে। নাইকি, অ্যাডিডাস, পুমাসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক স্পোর্টস ব্র্যান্ড ক্রমবর্ধমান ভোক্তা চাহিদাকে বিবেচনায় নিয়ে চামড়ার অ্যাথলেটিক উপকরণ উত্পাদন শুরু করেছে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) তথ্য অনুসারে, বিশ্বে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানির বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ৩ শতাংশ। সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১ হাজার ২৫০ কোটি ডলার আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
দেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাতের বেশির ভাগ কারখানা সাভারের হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীতে অবস্থিত। আর চামড়াজাত পণ্য তৈরির বেশির ভাগ কারখানা ঢাকার সাভার, আশুলিয়া, হাজারীবাগ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও যশোরে অবস্থিত।
বিটিএ জানায়, আনুমানিক ২২ বর্গফুট আকারের একটি চামড়া দিয়ে ১০ জোড়া উন্নত মানের চামড়ার জুতা তৈরি করা সম্ভব হয়, যার বাজারমূল্য দাঁড়ায় অন্তত ৫০ হাজার টাকা। দেশের পশুর চামড়ার মান অনেক ভালো। তাই ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ট্যানারি প্রতিষ্ঠানগুলো এলডব্লিউজি সনদ পেলে চামড়া রপ্তানিতে আরও ভালো করবে বাংলাদেশ।