জ্বালানি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি
প্রচুর পর্যটক, তবু খরচ তুলতে হিমশিম
কক্সবাজারের হোটেল–রেস্তোরাঁর মালিকেরা বলছেন, গত বছরের এ সময়ের তুলনায় এবার দ্বিগুণ পর্যটক এলেও তাঁরা সুবিধা করতে পারছেন না।
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের সুগন্ধা পয়েন্ট। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টা। তৃতীয় দফায় লঘুচাপের প্রভাবে সাগর প্রচণ্ড উত্তাল। ঝুঁকি নিয়ে গোসলে নামতে নিষেধ করে সৈকতের বালুচরে ওড়ানো হচ্ছিল লাল নিশানা। তবু সৈকতের এই এক পয়েন্টেই নেমেছিলেন অন্তত ২০ হাজার পর্যটক। পাশের কলাতলী, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে আছে আরও ১০-১২ হাজার। বেশির ভাগ পর্যটকই উত্তাল সাগরে নেমে আনন্দ–উল্লাসে মেতে উঠেছিলেন।
জানা গেছে, সেদিন শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, গেস্টহাউস, রিসোর্ট ও কটেজগুলোর ৫০ শতাংশ কক্ষে অতিথি ছিলেন। তাতে পর্যটকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি ছিল বলে ধারণা করা যায়। পরদিন শুক্রবার এলেন আরও ২০-৩০ হাজার পর্যটক। সব মিলিয়ে কক্সবাজারে দুই দিনে ৭০-৮০ হাজার পর্যটকের সমাগম।
এই মৌসুমে পর্যটক টানতে যেখানে হোটেলমালিকদের কক্ষভাড়ায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিতে হয়, সেখানে কোনো রকম ছাড়ের ঘোষণা না থাকার পরও হাজার হাজার পর্যটক এসে হাজির। তবে কক্ষভাড়ায় ছাড় কমিয়ে ২০-৩০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। তবে রেস্তোরাঁগুলোয় খাবারের দাম বাড়ানো হয়েছে। তারপরও হোটেল–রেস্তোরাঁর মালিকেরা বলছেন, গত বছরের এই মৌসুমের তুলনায় এবার দ্বিগুণ পর্যটক এলেও তাঁরা লাভের মুখ দেখছেন না।
কক্সবাজার চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সৈকত ভ্রমণে এসেছেন প্রায় চার লাখ পযটক। এতে পাঁচ শতাধিক হোটেল, মোটেল, রেস্তোরাঁ এবং শুঁটকি ও ঝিনুকপণ্য বিক্রির দোকানসহ অন্তত তিন হাজার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা হয়েছে ৩০০ কোটি টাকার বেশি। কিন্তু জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তেমন লাভের মুখ দেখেননি পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা।
এদিকে খাবারে দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন পর্যটকেরা। সুগন্ধা সৈকতে কথা হয় ঢাকার বাড্ডা থেকে আসা সালমান-মুন্নী দম্পতির সঙ্গে। মুন্নীর অভিযোগ, কলাতলী সৈকতের একটি রেস্তোরাঁয় সকালের নাশতায় একেকটি ডিম ২৫ টাকা ও পরোটা ২০ টাকা করে নিয়েছে। সুগন্ধা সৈকতের আরেকটি রেস্তোরাঁয় মাছ-ভাত-ডাল দিয়ে খাবারের দাম নিয়েছে ৫২০ টাকা করে, যা অন্যান্য এলাকার তুলনায় অনেক বেশি। চা-কফির দামও চড়া।
অন্যদিকে কক্সবাজার রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতেও সমিতির আওতাভুক্ত ১২৫টি রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্য বাড়ানো হয়নি। খাবারের তালিকা টেবিলের ওপর রাখা থাকে। তবে সমিতির বাইরে অনিবন্ধিত প্রায় ৩০০ রেস্তোরাঁয় খাবারের মূল্য বাড়িয়ে আদায়ের অভিযোগ আছে। যেমন এক বেলার খাবারের মূল্য আদায় করা হচ্ছে ৪০০-৪৫০ টাকা, যা সর্বোচ্চ ২৫০ টাকা হওয়ার কথা। ডিমভাজা ও পরোটা বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকা করে।
স্থানীয় চেম্বারের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, খাবারসহ সবকিছুর দাম বেশি হওয়া নিয়ে পর্যটকদের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে। এই ধারণা দূর করতে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে খাবারের দাম পুনর্নির্ধারণ করে রেস্তোরাঁগুলো তালিকা টাঙিয়ে রাখতে হবে। যেন ভুল–বোঝাবুঝির অবসান ঘটে।
সৈকতের লাইটহাউস এলাকায় গেস্টগাউস-রিসোর্ট-কটেজ আছে দুই শতাধিক। সব কটিতেই পর্যটক আছেন। আটতলা ওয়েল পার্ক রিসোর্টের ব্যবস্থাপক সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, দিনে কয়েক দফায় সাত-আট ঘণ্টা লোডশেডিং চলছে। এ সময় জেনারেটর চালিয়ে অতিথিদের সেবা দিতে হচ্ছে। জ্বালানির খরচ অতিথিদের কাছ থেকে আদায় করলে কক্ষভাড়া বেড়ে যায়। সে জন্য কক্ষভাড়া ঠিক রেখে ছাড় কমানো হয়েছে (৬০ থেকে ৩০ শতাংশ)। তারপরও খরচ মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কর্মচারীদের বেতন পরিশোধে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
আরেক আটতলা রিসোর্ট লেমিচের মালিক শাহদাত হোসেনও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, কক্ষভাড়া বাবদ যা আয় হচ্ছে তা দিয়ে জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও কর্মচারীর বেতনও তোলা যাচ্ছে না।
বৈরী আবহাওয়ার মধ্যেও চলতি আগস্টের ১৭ তারিখ পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণ করতে এসেছেন চার লাখের বেশি পর্যটক। আগামী ৩০ আগস্ট পর্যন্ত ১৪ বাকি দিনে আসার কথা আরও প্রায় তিন লাখ পর্যটক।
কক্সবাজার হোটেল রিসোর্ট গেস্টগাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পদক সেলিম নেওয়াজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘পর্যটকের সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়লেও এখন লাভের মুখ দেখছি না। ঘন ঘন লোডশেডিং, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে এ রকম হচ্ছে। আগে কক্ষভাড়া ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হতো। অথচ এখন খরচ পুষিয়ে আনতে তা ২০-৪০ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। হোটেলগুলোয় কর্মচারী আছেন ২০ থেকে ৮০ জন করে। তাঁদের বেতন–ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করতে না পেরে অনেকেই কর্মী ছাঁটাইয়ের চিন্তাভাবনা করছেন।’