ভোজ্যতেলের বাজারে উত্থান-পতনের পর নতুন বিনিয়োগ
২৮ বছর আগেও ভোজ্যতেলের বাজারে ছিল ৩৪টি প্রতিষ্ঠান। ছোট্ট বাজারে সে সময় প্রতিযোগিতা ছিল তীব্র। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিষ্ঠানও কমেছে। এখন নতুন করে আবার এ ব্যবসায় ফিরছে অনেক শিল্পগোষ্ঠী।
ভোজ্যতেলের ব্যবসায় দুই দশকের বেশি সময় ধরে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে ছিটকে পড়তে দেখা গেছে। এর প্রায় সবই যেন বাজারের একসময়কার সেরা খেলোয়াড়দের পতনের গল্প, যা মুখে মুখেও ফেরে। বাজার থেকে ছিটকে যাওয়া উদ্যোক্তাদের কেউ কেউ ঋণ খেলাপের চক্রে পড়ে এখন জেল খাটছেন। এমন করুণ গল্পের পরও নতুন করে শোনো যাচ্ছে নতুন নতুন বিনিয়োগের গল্প।
সর্বশেষ বিনিয়োগের গল্পে যোগ দিয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস। গত সপ্তাহে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে জাহাজ মার্কা ব্র্যান্ডের সয়াবিন তেল বাজারজাত করার ঘোষণা দিয়েছে তারা। স্মাইল ফুড প্রোডাক্টসের মতো গত আট বছরে ছয়টি প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগ করেছে। এই ছয় প্রতিষ্ঠানের বাজারহিস্যা বা অংশীদারি অবশ্য খুব বেশি নয়, মাত্র ১৩ শতাংশ। তবু ভোজ্যতেলের পতনপ্রবণ ব্যবসায়ে তা অন্তত যুক্ত হয়েছে।
আসছে নতুন ছয় প্রতিষ্ঠান
দেশে ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ে সর্বশেষ যুক্ত হওয়া স্মাইল ফুড প্রোডাক্টস গত বছরের আগস্ট থেকে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি শুরু করে। এরপর গত ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে প্রতিষ্ঠানটি ৮২৮ কোটি টাকা মূল্যের প্রায় ৭২ হাজার টন অপরিশোধিত সয়াবিন ও পামতেল আমদানি করেছে। এর মধ্যে বাজারজাতকরণের জন্য প্রায় ৬৫ হাজার টন তেল খালাস করেছে তারা। বন্ধ থাকা একটি পরিশোধন কারখানা ভাড়া নিয়ে সেখানে ভোজ্যতেল পরিশোধন করে বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। এই প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন চট্টগ্রামের একটি পারিবারিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের একজন উদ্যোক্তা।
এর আগে ২০২২ সালে ঢাকার নারায়ণগঞ্জে চালু হয়েছে ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ। চট্টগ্রামের সামুদা গ্রুপ ও সীকম গ্রুপের যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই কারখানায় বিনিয়োগ হয়েছে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এ কারখানার প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার টন অপরিশোধিত ভোজ্যতেল পরিশোধনের সক্ষমতা রয়েছে। আবার দিনে আড়াই হাজার টন সয়াবিন বীজ মাড়াই করে সয়াবিন তেল উৎপাদনের সক্ষমতাও রয়েছে কারখানাটির। সামুদা গ্রুপ ও সীকমের যৌথ উদ্যোগে ২০১৫ সালে খুলনায় রূপসা এডিবল অয়েল রিফাইনারি চালু হয়। খুলনার এই কারখানার দৈনিক ভোজ্যতেল পরিশোধনের ক্ষমতা ৮০০ টন।
এই তিন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ২০১৮ সালে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে বসুন্ধরা মাল্টি ফুড প্রোডাক্টস ভোজ্যতেল বাজারজাত শুরু করে। একই বছরে নারায়ণগঞ্জে সেনা এডিবল অয়েল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং মোংলায় এসজি অয়েল রিফাইনারি চালু হয়। এসজি অয়েল রিফাইনারি অবশ্য শতভাগ রপ্তানিমুখী কারখানা।
ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ে নতুন বিনিয়োগ করা সীকম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ভোজ্যতেলের বাজার খুবই অস্থিতিশীল। তবু গুণগত মানসম্পন্ন পণ্য দিয়ে বাজারে থাকার জন্যই এই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করেছি। তবে বর্তমানে ঋণপত্র খুলতে সমস্যা হচ্ছে এবং গ্যাসের সংকটে এই খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
ছিটকে গেছে ২৫ প্রতিষ্ঠান
নতুন বিনিয়োগের পরও দেশে ভোজ্যতেলের ব্যবসায়ে এখন সব মিলিয়ে ১১টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তবে ২৮ বছর আগেও এখনকার মতো ভোজ্যতেলের ব্যবসায় উদ্যোক্তার সংখ্যা এত কম ছিল না। সেই সময় বাজার ছোট হলেও উদ্যোক্তা ছিল বেশি। চট্টগ্রাম ও ঢাকায় ছোট ছোট পরিশোধন কারখানা গড়ে তুলেছিলেন উদ্যোক্তারা। দেশে উৎপাদন না হওয়ায় আমদানিনির্ভর এই বাজার বড় হতে থাকে। সেই সঙ্গে কমতে থাকে ব্যবসায়ীর সংখ্যা।
আমদানির তথ্যে দেখা যায়, ১৯৯৬ কিংবা ২০০০ সালেও দেশে ৩৫টি প্রতিষ্ঠান ৪০টি পরিশোধন কারখানার নামে অপরিশোধিত ভোজ্যতেল আমদানি করত। এরপরের বছরগুলোয় ১৭টি প্রতিষ্ঠান এই ব্যবসা থেকে ছিটকে যায়। এ সময় কয়েকটি নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়।
আমদানি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুই দশক আগে অর্থাৎ ২০০৩ সালের মধ্যে ভোজ্যতেলের ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়ে খুরাসানি অয়েল রিফাইনারি, হকস ফুড অ্যান্ড এডিবল অয়েল রিফাইনারি, আল নুর এডিবল অয়েলস, আফছার অয়েল অ্যান্ড ভেজিটেবল, হাবিব ভেজিটেবল প্রোডাক্টস ও জয়া ভেজিটবেল অয়েলের মতো রিফাইনারি। ২০০৬–০৭ দুই বছরে আবুল খায়ের এডিবল অয়েল, আলহাজ্ব অয়েল মিল, কেএসএ অয়েল রিফাইনারি, এম কে রিফাইনারি, আরএম অয়েল রিফাইনারি, এমএস রিফাইনারিসহ আটটি প্রতিষ্ঠান ছিটকে পড়ে। এরপর এ তালিকায় যুক্ত হয় এনজিএস গ্রুপের উত্তম অয়েল মিল ও খাতুনগঞ্জের ইয়াকুব অয়েল রিফাইনারি।
উদ্যোক্তারা জানান, প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরেই মূলত এসব পরিশোধন কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ভোজ্যতেলের মতো অস্থিতিশীল বাজার থেকে নিজেদের গুটিয়েও নিয়েছে অনেকে। আবুল খায়ের গ্রুপ এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। নব্বইয়ের দশকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া চট্টগ্রামের নাসিরাবাদের বালাগামওয়ালা ভেজিটবেল অয়েল প্রোডাক্টস কারখানা দিয়ে ভোজ্যতেলে হাতেখড়ি হয় গ্রুপটির। তবে ২০০৫ সালের পর এই ব্যবসা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয় তারা।
ভোজ্যতেলের ব্যবসা দিয়ে উত্থান হওয়া অনেক বড় গ্রুপেরও পতন হয় গত এক দশকে। এ তালিকায় রয়েছে চারটি বড় গ্রুপ। এই চারটি হলো নুরজাহান গ্রুপ, এসএ গ্রুপ, মোহাম্মদ ইলিয়াছ ব্রাদার্স ও মোস্তফা গ্রুপ। এই চার গ্রুপ একসময় ভোজ্যতেল আমদানিতে শীর্ষ পাঁচের মধ্যে ছিল।
ভোজ্যতেলের ব্যবসা থেকে ছিটকে যাওয়া ব্যবসায়ীদের দুজন প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, ‘১/১১–এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে লোকসানে তেল বিক্রি করতে বাধ্য করার কারণেই মূলত তাদের দুর্দিনের শুরু হয়। এরপরের বছরগুলোয় বিশ্ববাজারে দামের উত্থান–পতনে তারা ধরাশায়ী হন। তবে ভিন্ন আলোচনাও আছে বাজারে। যেমন নিজেদের সক্ষমতার চেয়ে বেশি বা আগ্রাসী বাণিজ্য এবং অতিমাত্রায় ব্যাংকঋণের নির্ভরতার ঝুঁকিই তাদের সর্বনাশ ডেকে আনে। ব্যাংকের টাকা শোধ না করে জমি কেনার অভিযোগও ছিল কয়েকজন উদ্যোক্তাদের বিরুদ্ধে। আবার ব্যবসায়ে বৈচিত্র্য না থাকায় ধকল কাটিয়ে উঠতে না পেরে বাজার থেকে সরে যেতে হয়েছে কাউকে কাউকে।
বাজার বড় হচ্ছে
নিত্যপণ্যের মধ্যে বাজারের আকারে সবচেয়ে বড় ভোজ্যতেল পাম ও সয়াবিনের বাজার। ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, এই বছর সয়াবিন ও পামতেল আমদানি হয়েছে ২২ লাখ টন। এতে ব্যয় হয় ২১৫ কোটি মার্কিন ডলার। এগুলোর শুল্কায়নমূল্য ও রাজস্বের হিসাবে আমদানি ব্যয় দাঁড়ায় ২৬ হাজার ১৮০ কোটি টাকা। খুচরা বাজারমূল্যে এই বাজারের আকার এখন প্রায় ৩৪ হাজার কোটি টাকা।
ভোজ্যতেলের বাজারে দুই দশকের উত্থান–পতনের মধ্যেও বৃহৎ অংশীদারি নিয়ে এখনো শীর্ষে রয়েছে পাঁচটি গ্রুপ। এই পাঁচ শিল্পগ্রুপ হলো যথাক্রমে টি কে গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (এমজিআই), সিটি গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল (রূপচাঁদা ব্র্যান্ড)।
ভোজ্যতেলের বাজারে শীর্ষস্থানে থাকা টি কে গ্রুপের পরিচালক মোস্তফা হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্ববাজার এখন স্থিতিশীল থাকলেও বেশির ভাগ সময়ই তা অস্থির থাকে। এ বাজারে উত্থান–পতন অনেক বেশি হয়। সে জন্য ঝুঁকিও নিতে হয় বেশি। তাই নতুন বিনিয়োগ এই বাজারের জন্য ভালো। নতুন কেউ বাজারে এলে বাজার সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখবে, প্রতিযোগিতা তৈরি হবে।