তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বা ভ্যালু অ্যাডিশন এক বছরের ব্যবধানে সাড়ে ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট বেড়েছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন ছিল ৫৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে সেটি বেড়ে ৬৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ হয়েছে।
তৈরি পোশাকশিল্প নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। মূলত পোশাক রপ্তানি থেকে তুলা, সুতা, কাপড় ও সরঞ্জামের আমদানি ব্যয় বাদ দিয়ে নিট রপ্তানি হিসাবটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও এই হিসাব পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রশ্ন আছে। সে কারণে মূল্য সংযোজনের পূর্ণাঙ্গ চিত্র উঠে আসছে না বলে মনে করেন তৈরি পোশাকশিল্পের একাধিক উদ্যোক্তা ও অর্থনীতিবিদেরা।
উদ্যোক্তারা বলছেন, তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানাগুলোতে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। পাশাপাশি সংযোগ শিল্পের সক্ষমতা ও বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানিও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই তৈরি পোশাক রপ্তানিতে সংযোজনও বাড়ছে। যদিও এক বছরের ব্যবধানে এক লাফে সাড়ে ১১ শতাংশীয় পয়েন্ট মূল্য সংযোজনের বিষয়টি কিছুটা খটকা লাগছে।
তবে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৈরি পোশাক উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কাঁচামালের ব্যবহার বাড়ছে। আমরা বেশি মূল্যের পোশাকও রপ্তানি করছি। সে কারণে পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন বাড়ছে। তবে অনেক কারণেই মূল্য সংযোজনের বিষয়টি ওঠানামা করতে পারে। তাই এক-দুই বছর বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তারপরই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানির জন্য ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলারের তুলা, সুতা, কাপড়, সরঞ্জামসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। তার মানে প্রকৃত তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলার। এই হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন হয়েছে ৬৫ দশমিক ৯৭ শতাংশ।
এর আগের অর্থবছরে ৪ হাজার ২৬১ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়। তার মধ্যে ১ হাজার ৯৪৪ কোটি ডলার কাঁচামাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়েছে। তার মানে প্রকৃত তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ২ হাজার ৩১৭ কোটি ডলার। সেই হিসাবে ওই বছর পোশাক রপ্তানিতে মূল্য সংযোজন দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ।
এই প্রতিবেদনে রপ্তানি হিসাবটি রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) থেকে নেওয়া হয়েছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন ডিপার্টমেন্ট থেকে কাঁচামাল আমদানির তথ্য নেওয়া হয়েছে, যা মূলত ব্যাক টু ব্যাক ঋণপত্র থেকে সংগ্রহ করা হয়। তবে ইপিবির রপ্তানির পরিসংখ্যান নিয়ে অনেক রপ্তানিকারকের সন্দেহ আছে।
পোশাক রপ্তানির পরিসংখ্যান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছ থেকে নিয়ে প্রকাশ করে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো বা ইপিবি। তবে এনবিআর থেকে নেওয়া তথ্য ইপিবির সঙ্গে মিলছে না। এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে টাকার হিসাবে পোশাক রপ্তানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ডলারের হিসাবে রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশের কাছাকাছি। রপ্তানি হিসাবে তফাত ৮৪৭ কোটি ডলারের।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৮৩ হাজার মেট্রিক টন তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই পোশাকের রপ্তানি মূল্য ৩ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ডলারের গড় বিনিময় মূল্য ছিল ৯৯ টাকা ৪৫ পয়সা। সেই হিসাবে বিদায়ী অর্থবছরে রপ্তানি হয়েছে ৩ হাজার ৮৫২ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। অথচ ইপিবি বলেছে, ৪ হাজার ৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।
এনবিআরের তথ্যানুযায়ী, বিদায়ী অর্থবছরে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ৩ হাজার ৮৫২ কোটি ডলার। এখন বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, কাঁচামাল আমদানিতে ১ হাজার ৫৯৯ কোটি ডলার ধরা হলে তাতে মূল্য সংযোজন দাঁড়ায় ৫৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে প্রায় ৬৬ শতাংশ মূল্য সংযোজনের কথা বলা হয়েছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিতভাবে পোশাক রপ্তানির মূল্য সংযোজনের তথ্য প্রকাশ করছে, যা খুবই ইতিবাচক। এই হিসাব পদ্ধতিতে আরও কিছু বিষয় বিবেচনায় নিলে মূল্য সংযোজনের মতো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রয়োজনীয় সবক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে।
গোলাম মোয়াজ্জেম আরও বলেন, ‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, ইপিবির রপ্তানির হিসাবের ১২-১৬ শতাংশ অর্থ কখনোই দেশে আসে না। আবার সম্প্রতি তৈরি পোশাক উৎপাদনে অপচয়ের হার বাড়ানো হয়েছে। এতে বেশি পরিমাণে কাঁচামাল আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে।’