একসময় বাঙালির ফাস্ট ফুড বলতে ছিল শিঙাড়া-সমুচা। শিঙাড়ার স্বাদ নেয়নি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। সকাল কিংবা বিকেলের নাশতায় জনপ্রিয়তা পায় খাবারটি। প্রবাসে গিয়েও শিঙাড়া-সমুচার স্বাদ ভুলতে পারছে না প্রবাসী বাংলাদেশিরা।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের শিঙাড়া-সমুচার প্রতি আকর্ষণ নতুন রপ্তানির বাজার তৈরি করেছে। শুধু বাংলাদেশিই নয়, ভারত ও পাকিস্তান অর্থাৎ সার্কভুক্ত বেশ কয়েকটি দেশের মানুষও স্বাদ নিতে চায় শিঙাড়া-সমুচার। ফলে রপ্তানি বাজারও বড় হচ্ছে এই খাদ্যপণ্যের।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যে দেখা যায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে শিঙাড়া-সমুচা, রুটি, পরোটার ও রোল—এই কটি প্যাকেটজাত হিমায়িত খাদ্যপণ্য থেকে রপ্তানি আয় এসেছে প্রায় ২০৬ কোটি টাকা বা প্রায় দুই কোটি ডলার। রপ্তানি হওয়া পণ্যের পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার টন। গড়ে প্রতি কেজি পণ্য থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ২ ডলারের কিছু বেশি বা ২০৪ টাকা।
রপ্তানিকারকেরা জানান, সবজি, মসলা, কলিজাসহ নানা পদ দিয়ে তৈরি খাদ্য আটার পাতলা মোড়কে মুড়িয়ে শিঙাড়া কিংবা সমুচা তৈরি হয়। আটার পাতলা মোড়ক, পরোটা, রুটি তৈরির কাজ হয় স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রে। কারখানায় মুড়িয়ে নেওয়ার কাজটি করা হয় হাতে হাতে। এ কারণে এসব রপ্তানিমুখী কারখানায় নারীদের কর্মসংস্থান বেশি।
রপ্তানিতে ১৯ প্রতিষ্ঠান
এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, উল্লিখিত পাঁচ ধরনের হিমায়িত খাবার রপ্তানি করছে মূলত ১৯টি প্রতিষ্ঠান। রপ্তানিকারক এসব প্রতিষ্ঠানের কারখানা চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নরসিংদী ও সিলেটে অবস্থিত। এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে রয়েছে নরসিংদী জেলার পলাশ উপজেলায় অবস্থিত প্রাণ ডেইরি লিমিটেড। প্রায় এক দশক আগে এই কারখানায় তৈরি শিঙাড়া-সমুচা রপ্তানি শুরু হয়। গত অর্থবছরে প্রাণ ডেইরি প্রায় ৯৩ কোটি টাকার শিঙাড়া, সমুচা ও পরোটা রপ্তানি করেছে। ঝটপট ব্র্যান্ডের নামে রপ্তানি হচ্ছে তাদের পণ্য।
জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ইউরোপ-আমেরিকায় বসবাসরত বাংলাদেশি, ভারতীয় ও পাকিস্তানিদের কাছে শিঙাড়া-সমুচা খুবই জনপ্রিয়। এ ছাড়া সার্কভুক্ত দেশগুলোর বাসিন্দাদের এ ধরনের হিমায়িত খাবারে আগ্রহ বেশি। প্রতিবছর এসব দেশে প্রাণের রপ্তানি বাড়ছে।
প্রাণ ডেইরির পরেই শীর্ষ রয়েছে যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের যৌথ বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত ইউরেশিয়া ফুড প্রসেসিং কোম্পানি। ঢাকার আশুলিয়ার অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে রপ্তানি করেছে প্রায় ৫১ কোটি টাকা বা ৫১ লাখ ডলার। এ ছাড়া রাজধানীর পল্টনের ফ্রেশ অ্যান্ড গ্রিন ফ্রোজেন ফুড, সাভারের কাজী ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ, গাজীপুরের গোল্ডেন হার্ভেস্ট, চট্টগ্রামের মাসুদ এগ্রো প্রসেসিং ফুড, সবজিয়ানা লিমিটেড ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের নানা ব্র্যান্ডের পণ্য শোভা পাচ্ছে বিদেশে।
শিঙাড়া-সমুচার রপ্তানি বাজারে আসছে নতুন নতুন প্রতিষ্ঠান। তেমনই একটি চট্টগ্রামে সাগরিকায় অবস্থিত রিভারেইন ফিশ অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি মূলত হিমায়িত মৎস্য রপ্তানিকারক। গত অর্থবছরে ৩০ কোটি টাকার হিমায়িত মাছ রপ্তানি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে শিঙাড়া-সমুচা ও পরোটার রপ্তানি সম্ভাবনা দেখে এই খাতেও বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে রিভারেইন ফিশ অ্যান্ড ফুড প্রসেসিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহজাহান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘হিমায়িত খাবারের মধ্যে শিঙাড়া, সমুচা, পরোটার রপ্তানি বাজারের সম্ভাবনা অনেক। রপ্তানি আয় বাড়াতে এই খাতে বিনিয়োগ করছি। মূলত গত অর্থবছর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করেছি।’ সামনে রপ্তানি বাড়বে বলে আশা করেন তিনি।
বড় বাজার যুক্তরাজ্য-যুক্তরাষ্ট্র-কানাডা
শিঙাড়া, সমুচা ও রুটি-পরোটা রপ্তানি হয় মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ২৩টি দেশে। এর মধ্যে বড় বাজার যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায়। গত অর্থবছরে মোট রপ্তানির ৮৩ শতাংশের গন্তব্য ছিল এই তিনটি দেশ। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে রপ্তানি হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা বা ৬৫ লাখ ডলারের শিঙাড়া-সমুচা ও পরোটা। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয় ৫৮ কোটি টাকা বা ৫৮ লাখ ডলার এবং কানাডায় রপ্তানি হয় ৪৭ কোটি টাকার পণ্য।
তিনটি দেশ ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরেও রপ্তানি হচ্ছে এসব পণ্য।
বৈশ্বিক বাজার
শিঙাড়া-সমুচা-পরোটার বৈশ্বিক আলাদা কোনো পণ্য শ্রেণীকরণ কোড (এইচএসকোড) নেই। মূলত পেস্ট্রি, কেক ও আদার ব্রেড ক্যাটাগরিতে রপ্তানি হয় এই খাবারগুলো। গত অর্থবছরে এই ক্যাটাগরিতে ৫ কোটি ৪১ লাখ ডলার রপ্তানি আয় এসেছে। এর মধ্যে দুই কোটি ডলারেরই রপ্তানি ছিল শিঙাড়া, সমুচা, রুটি-পরোটার।
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাবে, ২০২২ সালে পেস্ট্রি, কেক ও আদার ব্রেড ক্যাটাগরিতে রপ্তানি বাজার ছিল প্রায় ৩১ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ১০০ কোটি ডলারের। রপ্তানির বড় বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। ছয়টি দেশই বিশ্বের মোট আমদানির ৫০ শতাংশ আমদানি করছে। আর শিঙাড়া-সমুচা রপ্তানি করছে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশ।
বিদেশে বাংলাদেশি ব্র্যান্ড
বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে শিঙাড়া-সমুচা জনপ্রিয়তা পেলেও ইতিহাস বলছে, খাবারটি এসেছে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। মধ্যপ্রাচ্যের বণিকদের হাত ধরে ভারতবর্ষে এই খাবার আসে সুলতানি আমল বা ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে। ধীর ধীরে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ভারতবর্ষে। এখনকার খাদ্যাভ্যাসে হরেক রকম ফাস্ট ফুড জায়গা করে নিলেও এক দশক আগেও শিঙাড়া-সমুচা ছিল তুমুল জনপ্রিয়। টং দোকান, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যানটিন থেকে শুরু করে তারকা হোটেলেও এখনো কদর আছে এই খাবারের।
দেশীয় উদ্যোক্তারা দেশে প্যাকেটজাত আকারে বাজারজাত করছে এই খাবারগুলো। তাদের হাত ধরে বাংলাদেশি ব্র্যান্ডের শিঙাড়া-সমুচা ছড়িয়ে পড়ছে ইউরোপ থেকে আমেরিকায়। আসছে বৈদেশিক মুদ্রা।