হালকা প্রকৌশলশিল্প
কাঁচামালের সংকটে উৎপাদন কমেছে, বিপাকে উদ্যোক্তারা
সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলছে না ব্যাংকগুলো। তাতে বাজারে কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন শিল্পের কাঁচামালের দাম বাড়ে। দেশে ডলার–সংকট প্রকট হতে
থাকে। তখন ধাপে ধাপে আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জ্বালানি তেলের দামও বাড়ায় সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেলের ব্যবহার কমানো হয়। শুরু হয় বিদ্যুতের ভয়াবহ লোডশেডিং। শীত মৌসুম শুরু হলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হয়। তবে বাকি সমস্যাগুলো রয়ে গেছে। এতে সংকটে পড়েছে দেশের সম্ভাবনাময় হালকা প্রকৌশলশিল্প (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং)। সবচেয়ে বিপদে আছেন খাতটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
এ খাতের ব্যবসায়ীরা জানালেন, হালকা প্রকৌশল কারখানায় বিভিন্ন ধরনের ইস্পাত পণ্য, অ্যালুমিনিয়াম, বেয়ারিংসহ বিভিন্ন ধরনের খুচরা যন্ত্রাংশ ব্যবহৃত হয়। এসব কাঁচামালের দাম গত এক বছরে ৫০-৭৫ শতাংশ বেড়েছে। আবার ডলার–সংকটে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খুলতেও মাসের পর মাস ব্যাংকে ঘুরতে হচ্ছে। তাতে বাজারে কাঁচামালের ভয়াবহ সংকট তৈরি হয়েছে। পণ্য উৎপাদনের খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণে ক্রয়াদেশও কিছুটা কমেছে। যতটুকু–বা আসছে, তার একাংশ কাঁচামালের সংকটে উৎপাদন করা যাচ্ছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন কমবেশি প্রায় সব উদ্যোক্তা।
হালকা প্রকৌশলশিল্পের আঁতুড়ঘর রাজধানীর পুরান ঢাকা অঞ্চল। গত শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে সেখানকার টিপু সুলতান রোডে মোটরগাড়ি ও পাটকলের যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানা গড়ে ওঠে। পরে কিছু প্রতিষ্ঠান যন্ত্রাংশ তৈরি শুরু করে। কারখানাগুলো ধীরে ধীরে আশপাশের এলাকার পাশাপাশি বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য সম্ভাবনাময় খাতটি একটি গণ্ডির মধ্যেই আটকে গেছে। গাড়ির ইঞ্জিন ও বিভিন্ন কলকারখানার যন্ত্রপাতি মেরামত আর ছোটখাটো নাটবল্টু তৈরিতেই ব্যস্ত অধিকাংশ কারখানা। কিছু প্রতিষ্ঠান কৃষি ও নির্মাণকাজের যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক পণ্যের ছাঁচ বা মোল্ড, পেপার মিলের রোলার, রুটি ও বেকারির যন্ত্র ইত্যাদি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সদস্যসংখ্যা ৩ হাজার ২০০। তার বাইরে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে সারা দেশে অর্ধলক্ষাধিক প্রতিষ্ঠান আছে, যদিও ৯০ শতাংশ কারখানাই গাড়ির ইঞ্জিন থেকে শুরু করে নানা রকম শিল্পকারখানার যন্ত্রপাতি মেরামত করে। বাকি ১০ শতাংশ নাটবল্টুসহ খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন করছে।
চুয়াডাঙ্গায় তিন দশক ধরে কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করে জনতা ইঞ্জিনিয়ারিং। শুরুর দিকে গরুর লাঙলের বাতিল ফলা দিয়ে নতুন ফলা, ধানমাড়াইয়ের যন্ত্র প্যাডেল থ্রেশার তৈরি করলেও বর্তমানে কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী মৌসুমভিত্তিক প্রায় ৪০টি ধরনের যন্ত্র তৈরি করে তারা। এর মধ্যে আছে সিডার, বেডপ্লান্টার, আলু তোলা, ভুট্টা মাড়াই, ধান-গমমাড়াই, বিভিন্ন রকম স্প্রে, বাগান পরিচর্যায় আগাছা দমনের জন্য মিনি টিলার ইত্যাদি।
এই জনতা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্বত্বাধিকারী মো. ওলি উল্লাহ চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি করতে ৭০ হাজার ডলারের ঋণপত্র (এলসি) খুলতে
দুটি ব্যাংকে ছয় মাস ঘুরেছেন। ডলার–সংকটের কারণে কোনো ব্যাংকই ঋণপত্র খোলেনি। শেষে অন্য একটি ব্যাংকের সহযোগিতায় সম্প্রতি ঋণপত্র খুলতে পেরেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করে মো. ওলি উল্লাহ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘শতভাগ মার্জিন দিয়েও ঋণপত্র খুলতে পারছি না। ফলে কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে। দেশে বিকল্প কিছু কাঁচামাল পাওয়া গেলেও মান যথাযথ নয়। তাই কারখানার উৎপাদন কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছি। অন্যদিকে এই সুযোগে আমদানিকারকেরা বাজার দখল করে নিচ্ছেন। এতে দেশের কৃষি খাতের জন্য খুব ভালো কিছু হচ্ছে না।’
দেশের বিভিন্ন বিসিক শিল্প এলাকা ও রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকায় (ইপিজেড) হালকা প্রকৌশলশিল্পের বড় কারখানা আছে। সেসব কারখানা প্রকৌশল যন্ত্রপাতি, ইস্পাতের ইলেকট্রিক পণ্য, বাইসাইকেল ও মোটরসাইকেল রপ্তানি করছে।
প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে কমে গেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭৯ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি হয়, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি ছিল। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৬ কোটি ডলারের প্রকৌশল পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪১ দশমিক ২৪ শতাংশ কম।
কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। গত ছয়-সাত মাসে অনেকেই সংসার চালাতে ব্যবসার পুঁজি হারিয়েছেন। ধারকর্জ করে চলছেন অনেকে।আবদুর রাজ্জাক , সভাপতি, বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতি
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে হালকা প্রকৌশল খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো কেমন আছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প মালিক সমিতির সভাপতি আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নানামুখী সংকটে পড়েছি। গ্যাস ও ফার্নেস তেলের দাম বাড়ানোর কারণে যেসব প্রতিষ্ঠান লোহা গলিয়ে পণ্য তৈরি করে, তাদের উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। আবার চীন থেকে কাঁচামাল আনতে আগে কনটেইনারপ্রতি ১ হাজার ১০০ ডলার খরচ হতো। মাঝে তা বেড়ে ৩ হাজার ৮০০ ডলার হয়েছিল। এখন কিছুটা কমলেও লাগছে ৩ হাজার ২০০ ডলার। তার চেয়ে বড় সমস্যা, ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না, তাতে কোনো কোনো কাঁচামালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। কিছু কাঁচামালের সংকট তৈরি হওয়ায় উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।’
আবদুর রাজ্জাক আরও বলেন, কাঁচামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রয়াদেশ কমে গেছে। গত ছয়-সাত মাসে অনেকেই সংসার চালাতে ব্যবসার পুঁজি হারিয়েছেন। ধারকর্জ করে চলছেন অনেকে।
হালকা প্রকৌশল খাতের কুটির, অতি ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানকে সহায়তার জন্য বিদ্যুৎ বিলে ৫০ শতাংশ মূল্যছাড় দাবি করেন আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আর্থিক প্রণোদনা দিলে দুর্নীতির সুযোগ তৈরি হয়। মূলত ব্যবস্থার কারণে এমনটি হয়। তবে বিদ্যুৎ বিলের মাধ্যমে প্রণোদনা দিলে উদ্যোক্তারা টিকে থাকার মতো পুঁজি পাবেন।