পোশাকপল্লিতে কারখানা স্থাপন করছে না কেউ

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পোশাকপল্লি স্থাপনে ২০২১ সালে জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ জন্য বেজার কাছে ৩০০ কোটি টাকা জমা দিয়েছে বিজিএমইএ।

পোশাকপল্লির জন্য বরাদ্দ করা জমি। গত বছরের ছবি।
সংগৃহীত

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরে একটি গার্মেন্ট ভিলেজ তথা পোশাকপল্লি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০২১ সালের মার্চে জমি বরাদ্দ পায় বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। এ জন্য তারা কয়েক ধাপে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) কাছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা জমা দেয়। কিন্তু জমি বরাদ্দ চুক্তির দুই বছরেও কেউ সেখানে কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু করেননি।

বেজার কর্মকর্তারা বলছেন, পোশাকপল্লির জন্য নির্ধারিত স্থানে প্রাথমিক অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ-পানিসহ বিভিন্ন পরিষেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব সুবিধা নিয়ে কাছাকাছি এলাকায় অন্য খাতের বেশ কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখন উৎপাদন পর্যায়ে রয়েছে। ফলে বিজিএমইএর সদস্যরাও শিল্প স্থাপন শুরু করতে পারেন।

অন্যদিকে বিজিএমইএ নেতাদের দাবি, পোশাকপল্লি স্থাপনের জন্য বেজা তাদের যে জমি দিয়েছে, সেখানে কোনো কাজই এখনো শেষ হয়নি। সব ধরনের পরিষেবাসহ পুরো জমি একসঙ্গে না পেলে ব্যবসায়ীরা শিল্প স্থাপনে রাজি নন।

প্রস্তাবিত পোশাকপল্লিতে কারখানা স্থাপনে ব্যবসায়ীদের অনেকেরই আগ্রহের অভাব রয়েছে। সেখানে অবশিষ্ট অবকাঠামো ও পরিষেবার কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। এরপর যদি কেউ নির্মাণকাজ শুরু না করেন, তাহলে বরাদ্দ বাতিলসহ প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শেখ ইউসুফ হারুন, নির্বাহী চেয়ারম্যান, বেজা

এ বিষয়ে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবিত পোশাকপল্লিতে কারখানা স্থাপনে ব্যবসায়ীদের অনেকেরই আগ্রহের অভাব রয়েছে। সেখানে অবশিষ্ট অবকাঠামো ও পরিষেবার কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। এরপর যদি কেউ নির্মাণকাজ শুরু না করে, তাহলে বরাদ্দ বাতিলসহ প্রয়োজনে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

পোশাকপল্লি স্থাপনের জন্য বেজার কাছে প্রথমে ৫০০ একর জমি চেয়েছিল বিজিএমইএ। সেই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের ২১ মার্চ বেজা ও বিজিএমইএ একটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে। কিন্তু পরে অনেক প্রতিষ্ঠানই জমি নিতে আগ্রহ দেখায়নি। কয়েক দফা আলোচনা শেষে প্রায় তিন বছর পর ২০২১ সালের ১৫ মার্চ বিজিএমইএর ৪১টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জমি বরাদ্দের চুক্তি করে বেজা। এরপর একটি প্রতিষ্ঠান চুক্তি প্রত্যাহার করে নেয়। তবে পরবর্তী সময়ে আরও ছয়টি প্রতিষ্ঠান সেখানে নতুন করে জমি চেয়েছে।

সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে পোশাকপল্লির জন্য জমি বরাদ্দ রাখা হয়েছে প্রায় ২৭৭ একর। সেখানে প্রস্তাবিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৭৬ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। কর্মসংস্থান হওয়ার কথা প্রায় এক লাখ।

বেজা জানায়, চুক্তির সময় প্রতিষ্ঠানগুলো ২৫ শতাংশ করে টাকা জমা দিয়েছিল। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৫ শতাংশ প্রতিষ্ঠান অর্ধেক কিংবা তার কিছু বেশি টাকা জমা দিয়েছে। জমি বুঝে নেওয়ার জন্য পুরো টাকা এখনো কেউই জমা দেয়নি।

পোশাকপল্লির জন্য নির্ধারিত স্থানে মাটি ভরাট এবং বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থাসহ কোনো কাজই শেষ হয়নি। জমিটি এখনো মূল সড়কের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট নিচে রয়েছে। এ ছাড়া তিন-চার বছর বিলম্বের কারণে নির্মাণ খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা এখন হতাশ।
শহীদুল্লাহ আজিম, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বিজিএমইএ।

অগ্রগতি কত দূর

দেশের অর্থনীতিতে গতি বাড়াতে ২০৩০ সাল নাগাদ সরকারের ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে অবস্থান ও অন্যান্য সুবিধার দিক থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর বিনিয়োগকারীদের কাছে বেশ পছন্দের। এ জন্য দেশি-বিদেশি অনেক প্রতিষ্ঠানের মতো বিজিএমইএ সেখানে গার্মেন্ট ভিলেজ বা পোশাকপল্লি স্থাপনের আগ্রহ দেখিয়েছিল।

সর্বশেষ তথ্য অনুসারে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে এখন পর্যন্ত ১৪৪টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে মোট ৫ হাজার ২৪৮ একর জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানে পাঁচটি প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে। এ ছাড়া আরও ১৮টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের নির্মাণকাজ বিভিন্ন পর্যায়ে চলমান রয়েছে।

বেজার কর্মকর্তারা জানান, পোশাকপল্লির জন্য নির্ধারিত স্থানের বেশির ভাগ অংশের ভূমি উন্নয়নের কাজ শেষ হয়েছে। সেখানে বিদ্যুৎ-সংযোগ ও প্রয়োজনীয় পানির ব্যবস্থাও রয়েছে। এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে গ্যাস-সংযোগের ব্যবস্থা। ফলে কেউ কারখানা নির্মাণ শুরু করলে দ্রুততম সময়ে তাদের জন্য গ্যাস-সংযোগের ব্যবস্থা করবে বেজা। এ ছাড়া সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য ঠিকাদার নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।

বিজিএমইএ কী বলছে

জানতে চাইলে বিজিএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম প্রথম আলোকে বলেন, পোশাকপল্লির জন্য নির্ধারিত স্থানে মাটি ভরাট এবং বিদ্যুৎ ও পানির ব্যবস্থাসহ কোনো কাজই শেষ হয়নি। নির্ধারিত জমিটি এখনো মূল সড়কের চেয়ে পাঁচ-ছয় ফুট নিচে রয়েছে। এ ছাড়া তিন-চার বছর বিলম্বের কারণে নির্মাণ খরচ ইতিমধ্যে কয়েক গুণ বেড়েছে। সব মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা এখন হতাশ।

শহীদুল্লাহ আজিম আরও বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত বেজাকে ২৯৫ কোটি টাকা দিয়েছি। এই টাকা দিয়েই তো অনেক কিছু করে দিতে পারত। এভাবে দীর্ঘদিন অর্থ ফেলে না রেখে অনেক ব্যবসায়ী এখন টাকা ফেরত নিতে চাচ্ছেন।’

কারখানার বর্জ্য দিয়ে যেন পরিবেশদূষণ না হয়, সে জন্য বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কয়েকটি কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার (সিইটিপি) স্থাপন করবে বেজা। শিল্পনগরে থাকা সব প্রতিষ্ঠানকে নির্দিষ্ট মাশুলের বিনিময়ে এসব সিইটিপি ব্যবহার করতে হবে। বেজা বলছে, এটি ব্যবহারের মাধ্যমে পোশাক প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্জ্য পরিশোধন খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ সাশ্রয় হবে।

এদিকে আগ্রহী অনেক পোশাকশিল্প প্রতিষ্ঠানই সিইটিপি ব্যবস্থায় আসতে রাজি নয়। এসব প্রতিষ্ঠান নিজেরাই ইটিপি করতে চায়। এ নিয়ে বেজা ও বিজিএমইএর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে দ্বিমত চলছে।

সেবা নিতে নিবন্ধন করেনি কেউ

বেজা কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান জমি বরাদ্দের চুক্তি করলে অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারী হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তবে সেখানে কোনো পরিষেবা পেতে হলে বেজার এক দরজায় সেবা বা ওএসএস পেতে হলে নিবন্ধন করতে হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিজিএমইএর কোনো সদস্য বিনিয়োগকারী বেজার ওএসএসে নিবন্ধন করেনি।

সরকারি সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, দফায় দফায় আলোচনা করে বিজিএমইএর সদস্যদের বেজার ওএসএসে নিবন্ধন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু তারা তা করেনি। এ বিষয়ে বিজিএমইএর সহসভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, আগে যা টাকা জমা দিয়েছি, সে অনুযায়ী কিছু হয়নি। এখন সব প্রস্তুত হওয়ার আগে আবার টাকা খরচের প্রক্রিয়ায় কেন যাবে?

আইনি ব্যবস্থা নেবে বেজা

আলাপকালে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান অবস্থায় মূল সড়কের পাশে যাঁরা জমি বরাদ্দ পেয়েছেন, তাঁরা কাজ শুরু করতে পারেন। আগামী পাঁচ-ছয় মাসের মধ্যে আমরা বাকি সব কাজ শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছি।

এরপর যদি কেউ কারখানা নির্মাণের কাজ শুরু না করেন, তাহলে বরাদ্দ বাতিলসহ তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

শেখ ইউসুফ হারুন আরও বলেন, ‘বরাদ্দ বাতিল করা বেজার মূল কাজ না। আমরা চাই পোশাকপল্লিতে দ্রুত শিল্প নির্মাণ সম্পন্ন হোক। বিজিএমইএ যে উদ্দেশ্যে জমি নিয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করুক।’