বিজিএমইএর পর্ষদ বাতিল, প্রশাসক বসাল সরকার
দেশের শীর্ষ রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর নেতৃত্ব নিয়ে আড়াই মাসের টানাপোড়েন অবশেষে শেষ হলো। আজ রোববার একাধিক অভিযোগে সংগঠনটির পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। প্রশাসকের দায়িত্ব পেয়েছেন রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন।
গত ৫ আগস্ট দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, চট্টগ্রাম চেম্বার, ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) পর্ষদ ভেঙে প্রশাসক নিয়োগ দেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় বিজিএমইএতেও প্রশাসক বসল। মূলত বিদায়ী সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী, এমনকি আওয়ামী লীগের পদধারী ব্যক্তিও এই সংগঠনগুলোতে নেতৃত্বে ছিলেন।
বিজিএমইএর পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য সংগঠন-২ শাখা আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছে, গত ২৪ আগস্ট এস এম মান্নান সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করার পর পর্ষদ পুনর্গঠন করা হলেও সেটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। এ ছাড়া তৈরি পোশাকশিল্পের সাম্প্রতিক অস্থিরতা ও শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে পর্ষদ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। মূলত এসব অভিযোগে পর্ষদ ভেঙে ১২০ দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন পর্ষদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিজিএমইএর নির্বাচনকেন্দ্রিক দুটি জোট সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরাম। গত ১৫ বছরে একবার ছাড়া সব মেয়াদেই সম্মিলিত পরিষদ সংগঠনটির নেতৃত্ব দিয়েছে। সম্মিলিত পরিষদের নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম এবং সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুস সালাম মুর্শেদী ও শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন এবং আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক সিদ্দিকুর রহমান। প্রভাবশালী এই জোট গত মার্চের নির্বাচনে সব কটি পদে বিজয়ী হয়। সভাপতি হন ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান। যদিও ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর তাঁকে আর দেখা যায়নি। তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা মামলাও হয়েছে।
বিজিএমইএর পর্ষদ ভেঙে দিতে ক্রীড়নকের ভূমিকায় ছিলেন সংগঠনটির নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট ফোরামের নেতারা। তাঁরা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংগঠনের সভাপতিসহ পর্ষদের অন্য সদস্যদের পদত্যাগের দাবি তোলেন। ৭ আগস্ট পর্ষদের ওপর অনাস্থা জানিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতিকে স্মারকলিপি দেন ফোরাম নেতারা। ওই দিন সম্মিলিত পরিষদের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের হট্টগোল হয়। গত মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অনিয়মসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠনটির পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবিতে ১৯ আগস্ট বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগের মহাপরিচালককে চিঠি দেন ফোরাম নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পর্ষদ ভেঙে দিতে নেতাদের ওপর চাপ, মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়ার পাশাপাশি ফোরাম নেতারা অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায়েও যোগাযোগ করেন। বাণিজ্য সংগঠন অনুবিভাগ অভিযোগের বিষয়ে দুই দফা শুনানি করে। এদিকে ফোরামের নেতারা পর্ষদ ভেঙে দেওয়ার দাবি করলেও তাঁরা প্রশাসকের পরিবর্তে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে একটি অন্তর্বর্তী পর্ষদ গঠনের চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রে সভাপতি হিসেবে সাবেক একজন সহসভাপতির নামও প্রস্তাব করা হয়। যদিও বিদায়ী পর্ষদ তাতে রাজি হয়নি। উভয় জোটের এই দর-কষাকষির প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যক্তির পাশাপাশি কয়েকজন জ্যেষ্ঠ ব্যবসায়ী নেতাও যুক্ত ছিলেন।
এদিকে নেতৃত্ব নিয়ে যখন টানাপোড়েন চলছিল, তখন সম্মিলিত পরিষদ তাদের গঠিত পর্ষদ টিকিয়ে রাখতে চেষ্টা চালায়। প্রথমেই তারা পর্ষদ থেকে এস এম মান্নানকে সরিয়ে জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামকে সভাপতি নির্বাচিত করে। এ ছাড়া চলতি মাসে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী মনিরুজ্জামানকে সম্মিলিত পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিজিএমইএর সাবেক একজন নেতা বলেন, শ্রমিক অসন্তোষের কারণে বিজিএমইএর পর্ষদ নিয়ে সরকার খুবই সতর্ক অবস্থানে ছিল। সরকারও চাচ্ছিল ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্তর্বর্তী নেতৃত্ব আসুক। সে জন্য সম্মিলিত পরিষদ ও ফোরামের মধ্যে সমঝোতার জন্য সরকারও দু-তিন সপ্তাহ অপেক্ষা করেছে। সেটি না হওয়ায় প্রশাসক বসানো হয়েছে।
জানতে চাইলে বিজিএমইএর সদ্য বিদায়ী সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কোন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছি, সেটি সবাই অবগত আছেন। শ্রম অসন্তোষ নিরসনে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। এরপরও পর্ষদ কেন ভেঙে দেওয়া হলো, সেটি আমার জানা নেই।’
জানা যায়, প্রশাসক নিয়োগের আগে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কয়েক দফা বৈঠক করেন ফোরামের নেতারা। এতে প্রশাসকের অধীনে ছয়-আট সদস্যের একটি অন্তর্বর্তী পর্ষদ কিংবা টাস্কফোর্স গঠন করে বিজিএমইএ পরিচালনা করার বিষয়ে আলোচনা হয়। যদিও বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
জানতে চাইলে ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রশীদ আহমেদ হোসাইনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিজিএমইএতে সংস্কার চাই। পরিচ্ছন্ন ভোটার তালিকা প্রণয়ন করে সুষ্ঠু নির্বাচন, অনিয়ম তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তি, বিইউএফটির ট্রাস্টি বোর্ড পুনর্গঠনসহ বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব আমরা শিগগিরই প্রশাসকের কাছে লিখিত আকারে দেব।’