মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্য–ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে
চোরাচালান নিরুৎসাহিত করে মিয়ানমারের সঙ্গে বৈধ পথে বাণিজ্য চালুর জন্য ২৯ বছর আগে ১৯৯৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর টেকনাফ স্থলবন্দর স্থাপন করা হয়। শুরুর দিকে কয়েক বছর আমদানি-রপ্তানি ঠিকঠাক চললেও পরবর্তী সময়ে চোরাচালান ও হুন্ডিতে লেনদেন বেড়ে যায়। ফলে সীমান্ত বাণিজ্যে ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, একটি প্রভাবশালী রাজনৈতিক মহল সীমান্ত বাণিজ্যের আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমার থেকে আমদানি পণ্যের সঙ্গে লুকিয়ে হেরোইনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ও সোনার চালান নিয়ে আসছে। কিন্তু টেকনাফ স্থলবন্দরে মাদক ও সোনার চালান চিহ্নিত করার কোনো যন্ত্র না থাকায় এসব অবৈধ পণ্য ধরা পড়ে না। এগুলোর দাম পাঠানো হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ব্যবসায়ী প্রথম আলোকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে এই স্থলবন্দর নিয়ন্ত্রণ করেন কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি। গত ২১ আগস্ট চট্টগ্রাম শহর থেকে তাঁকে গ্রেপ্তারের পরও এই বন্দর নিয়ন্ত্রণ করছেন তাঁর লোকজন তথা সমর্থনপুষ্ট সিন্ডিকেট। যেমন টেকনাফ স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি আমিনুর রহমান হলেন বদির ছোট ভাই।
ঘাটতি বাণিজ্য কত দিন
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মি নামে (এএ) একটি গোষ্ঠীর সশস্ত্র সংঘাতের কারণে সাত মাস ধরে রপ্তানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে সীমিত পরিসরে টেকনাফের উল্টো দিকের মংডু টাউনের পরিবর্তে শত কিলোমিটার দূরের সিঁথুয়ে (আকিয়াব) ও ইয়াঙ্গুন থেকে কার্গো জাহাজে করে কিছু পণ্য আমদানি করা হয়। স্থানীয় ব্যবসায়ী এম কায়সার জানান, পরিস্থিতি বুঝে তিনিসহ কয়েকজন কিছু পণ্য আমদানি করেন।
আমদানিকারক ওমর ফারুক জানান, মিয়ানমারে তাঁর দেড় হাজার মেট্রিক টন আদা, দুই হাজার টন শুঁটকি ও এক হাজার টন শুকনা সুপারি আটকে আছে। যুদ্ধের কারণে টেকনাফ বন্দরে আনতে পারছেন না।
মিয়ানমারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা অনেক। কিন্তু নানা কারণে এত দিন সেই বাজার ধরা যায়নি। এখন সে দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। চোরাচালান-হুন্ডি বেড়েছে।আবু মোর্শেদ চৌধুরী, সভাপতি, কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ মাসে আমদানি হয়েছে ৮০৮ কোটি ৪০ লাখ টাকার পণ্য। এ সময় কোনো পণ্য রপ্তানি হয়নি।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আমদানি হওয়া পণের মধ্যে রয়েছে কাঠ, রুই ও কাতল মাছ, শুঁটকি, বরই, আচার, পেঁয়াজ, প্লাস্টিক পণ্য ইত্যাদি। অন্যদিকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে আছে সিমেন্ট, গেঞ্জি, থান কাপড়, প্লাস্টিকের পাইপ, মানুষের মাথার চুল, অ্যালুমিনিয়াম পণ্য, হাঙর মাছ, চামড়া, অক্স পেনিস ইত্যাদি।
গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে এই স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে আমদানি হয়েছে ১ হাজার ৫৪৫ কোটি ৮১ লাখ টাকার পণ্য। আর বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫ কোটি ১০ লাখ টাকার পণ্য।
শুল্ক বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৯ বছরে টেকনাফ স্থলবন্দর দিয়ে মিয়ানমার থেকে মোট ১০ হাজার ৩১৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৯২ কোটি টাকার পণ্য। এ সময় দেশটির সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্যে ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ২৫ কোটি ১৬ লাখ টাকায়। আমদানি পণ্যের বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১৩ হাজার ৬৭৭ কোটি টাকা।
জানতে চাইলে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, মিয়ানমারে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা অনেক। কিন্তু নানা কারণে এত দিন সেই বাজার ধরা যায়নি। এখন সে দেশে যুদ্ধের পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে আছে। চোরাচালান ও হুন্ডি বেড়েছে।
এদিকে সীমান্তে চোরাচালান চলছেই। বিজিবি সূত্র জানায়, শেষ ১০ আগস্ট মিয়ানমার থেকে পাচারের সময় ২৮ কোটি টাকা মূল্যের ২৯ কেজি সোনার একটি চালান ধরা হয়। এ সময় গ্রেপ্তার করা হয় ইয়াহিয়া খান (৪৫) ও আনোয়ার সাদেক (৪০) নামের দুই রোহিঙ্গাকে। পরদিন তাঁদের আদালতে নেওয়া হলে তাঁদের কারাগারে পাঠানো হয়। গত কয়েক বছরে বিজিবি, কোস্টগার্ড ও পুলিশ আমদানি পণ্যবোঝাই ট্রলার থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা, চোরাই কাঠসহ বিভিন্ন মালামাল আটক করেছে।
মিয়ানমার-বাংলাদেশ বাণিজ্য
* গত ৮ মাসে ৮০৮ কোটি টাকার পণ্য আমদানি হলেও কোনো রপ্তানি হয়নি।
* গত ২৯ বছরে ১০ হাজার ৩১৭ কোটি টাকার পণ্য আমদানির বিপরীতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ২৯২ কোটি টাকার পণ্য। বাণিজ্য–ঘাটতি হয়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা।
* পণ্য আমদানির বিপরীতে রাজস্ব আদায় হয়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা।
টেকনাফ স্থলবন্দর সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এহতেশামুল হক প্রথম আলোকে বলেন, নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও অর্ধশতাধিক ব্যবসায়ী আমদানি-রপ্তানি ধরে রেখেছেন। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারে গিয়ে রপ্তানি পণ্যের বাজার সৃষ্টির সুযোগ পাচ্ছেন না। এ কারণে রপ্তানি শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে, আর ঘাটতি বেড়েছে।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা মো. লুৎফুল হক বলেন, বাণিজ্য–ঘাটতি কমাতে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মিয়ানমারে রপ্তানি পণ্যের বাজার সৃষ্টির উদ্যোগে নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে।
কাজ চলে রোহিঙ্গা শ্রমিক দিয়ে
সম্প্রতি এক দুপুরে টেকনাফ স্থলবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটক তালাবদ্ধ। বিকল্প পথে রোহিঙ্গা শ্রমিকেরা ভেতরে ঢুকে জেটিতে একটি কার্গো থেকে হিমায়িত মাছ খালাস করছেন। তবে এসব শ্রমিক রোহিঙ্গা শরণার্থী বলে অভিযোগ করেছেন স্থানীয় শ্রমিকেরা। এ নিয়ে তাঁরা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। রোহিঙ্গা শ্রমিকদের নেতা কবির আহমদ ওরফে লালু মাঝি জানান, তাঁর মতো ১৭ রোহিঙ্গা মাঝির অধীনে অন্তত এক হাজার রোহিঙ্গা শ্রমিক আছেন।
স্থানীয় শ্রমিকেরা জানান, সাবেক সংসদ সদস্য বদির প্রভাবে তাঁর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত নজরুল ইসলাম ১৫ বছর ধরে রোহিঙ্গা শ্রমিক সরবরাহের কাজ করে আসছেন। এ নিয়ে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও নজরুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া গেছে। ৫ আগস্ট থেকে তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন।
স্থলবন্দরের নানা সমস্যা
ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২৯ বছরেও এই স্থলবন্দরের উন্নতি ঘটেনি। বন্দরে গাড়ি পার্কিং ও শ্রমিকের বসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই। খোলা মাঠে বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হয় মালামাল। টাকা লেনদেনের জন্য ব্যাংকের কোনো শাখা এবং আমদানি-রপ্তানিকারকদের কার্যালয় নেই। আবার স্থলবন্দর হলেও কর আদায় হয় নৌবন্দর হিসেবে। নদীর খননও করা হয় না। ট্রলার থেকে পণ্য খালাস করে সরাসরি ট্রাকে বোঝাই করা হলেও ওয়্যারহাউস চার্জ আদায় করা হয়। নেই ক্যানটিন ও টয়লেটের ব্যবস্থা।
বন্দরের উত্তর পাশের খোলা জায়গায় স্তূপ করে রাখা আছে মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আনা সেগুন কাঠ, যা বিজিবি সম্প্রতি জব্দ করে স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের জিম্মায় রেখেছে। এই কাঠের দাম প্রায় ১০ কোটি টাকা বলে জানান বন্দরের এক কর্মকর্তা।
স্থলবন্দর পরিচালনাকারী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড পোর্ট টেকনাফ লিমিটেডের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বন্দর কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ীদের সাধ্যমতো সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। বন্দরের উন্নয়ন ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি শুল্ক-কর পরিশোধ করা পণ্য ছুটির দিনেও খালাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে।