প্রায় ৩৩ বছর পর নির্বাচনে প্রথম ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন বিজিএপিএমইএ সদস্যরা

বিজিএপিএমইএ

প্রায় ৩৩ বছর আগে বাণিজ্য সংগঠন হিসেবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন পায় তৈরি পোশাকশিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য সরবরাহকারী কারখানামালিকদের সংগঠন বিজিএপিএমইএ। এরপর একে একে সাতজন সভাপতি দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেই সমঝোতার ভিত্তিতে পর্ষদ গঠন করায় কখনোই ভোট দেওয়ার সুযোগ পাননি সাধারণ সদস্যরা।

তবে বাণিজ্য সংগঠনটির সর্বশেষ কমিটির কয়েকজন নেতার দ্বন্দ্বের কারণে সমঝোতায় নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রথাটি ভাঙতে যাচ্ছে। প্রথমবারের মতো ২০২৪-২৬ মেয়াদের পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একযোগে ভোট হবে আগামী শনিবার। এর ফলে ৩৩ বছর পর ভোট দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন সংগঠনের ৪৬০ জন সদস্য। যদিও সদস্যদের অনেকেই ভোটার হননি। সংগঠনটির সক্রিয় সদস্য ১ হাজার ২০০ জন।

নির্বাচনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ২১টি পরিচালক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ৪২ জন প্রার্থী। তাঁরা দুইটি প্যানেলের অধীনে নির্বাচন করছেন।

প্যানেল দুইটি হচ্ছে—ঐক্য পরিষদ ও অ্যাকটিভ মেম্বার্স ইউনিয়ন। ঐক্য পরিষদ প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনের সাবেক পরিচালক ও আদজি ট্রিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহরিয়ার। আর অ্যাকটিভ মেম্বার্স ইউনিয়ন প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পলি প্ল্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাছিরুল আলম। উভয় প্যানেলই নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছে। প্রার্থীরা এখন শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত আছেন।

বিজিএপিএমইএর সাবেক সভাপতি আবদুল কাদের খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রথমবারের মতো আমাদের সংগঠনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হচ্ছে। প্রার্থীরা পাঁচ তারকা হোটেলে ভোটারদের নিয়ে অনুষ্ঠান করছেন। সব মিলিয়ে ভোটারদের মধ্যে উৎসাহ–উদ্দীপনা কাজ করছে। আশা করছি, শেষপর্যন্ত সুন্দর পরিবেশে ভোট হবে।’
সাম্প্রতি ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা নির্বাচনে ভোট প্রায় ‘নাই’ হয়ে গেছে। জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সংগঠন জেলা চেম্বারগুলোর অধিকাংশের কমিটি হয়েছে ভোটাভুটি ছাড়া। পণ্যভিত্তিক সংগঠনগুলোতেও সমঝোতার মাধ্যমে কমিটি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ জেলা ও পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সরকার-ঘনিষ্ঠ কিংবা আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের পদধারী ব্যবসায়ীরা। তাঁদের মধ্যে অনেকে বছরের পর বছর ধরে আঁকড়ে আছেন পদ।

জানা যায়, পৌনে তিন বছর আগে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজিএপিএমইএর সভাপতি হন মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁর নেতৃত্বে গঠিত কমিটিতে প্রথম সহসভাপতির পদে বসেন মোহাম্মদ বেলাল। এক বছর দায়িত্ব পালনের পর তাঁরা নিজেরা দ্বন্দ্বে জড়ান। সভাপতি অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম অঞ্চলে প্রতি ইউপির (ইউটিলাইজেশন পারমিশন) বিপরীতে অনৈতিকভাবে ২ হাজার টাকা করে নিচ্ছেন প্রথম সহসভাপতি। আর প্রথম সহসভাপতির অভিযোগ, গত নির্বাচনে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন সভাপতি।

দ্বন্দ্বের একপর্যায়ের সভাপতিকে দায়িত্ব থেকে সরাতে প্রথম সহসভাপতির পক্ষের একজন সদস্য উচ্চ আদালতে মামলা করেন। মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ দাখিল করেন তিনি। পরবর্তী পর্ষদ নির্বাচনের ভোটার তালিকা নিয়েও মামলা করেন মোহাম্মদ বেলালের পক্ষের একজন পরিচালক। আবার সংগঠনের সচিবকে হঠাৎ করে এক মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেওয়া নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। গত সেপ্টেম্বরে সভাপতিকে অপসারণ ও পরে কমিটি বাতিল করে প্রশাসক বসানোর সিদ্ধান্ত দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এরপরই মূলত নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের তৎপরতা শুরু হয়। সংগঠনের বিদায়ী কমিটির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করলেও প্রথম সহসভাপতি মোহাম্মদ বেলাল নির্বাচন করছেন।

বিজিএপিএমইএর নির্বাচনে ঐক্য পরিষদ প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংগঠনের সাবেক পরিচালক ও আদজি ট্রিমসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহরিয়ার। ঢাকা অঞ্চলে এই প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন—মোজাহারুল হক, মনিরুজ্জামান মোল্লা, মোবারক উল্লাহ মজুমদার, মো. ফিরোজ উদ্দীন, কাজী ফাহাদ, মো. সাইফুল ইসলাম, মো. আতিকুর রহমান, কাজী আশরাফুল হক, শাকিল হোসেন, মো. আজাদ খান, কাজী তাইফ সাদাত, মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, জহিরউদ্দিন মো. বাবর, এ টি এম কামরুজ্জামান ও তাপস কর্মকার। চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঐক্য পরিষদ প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন—খন্দকার লতিফুর রহমান, মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ চৌধুরী, মোহাম্মদ হোসাইন আল ওসমান, বেলাল উদ্দিন এবং মোহাম্মদ ফজলুল করিম।

ঐক্য পরিষদ প্যানেলের লিডার মো. শাহরিয়ার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোটারদের কাছ থেকে অনেক সাড়া পাচ্ছি। আশা করছি নির্বাচন উৎসবমুখর পরিবেশে হবে। নির্বাচনে যাঁরা জয়ী হবেন, তাঁদের নিয়ে আমরা সংগঠন ও সদস্যদের স্বার্থে কাজ করব।’ তিনি পূর্ণ প্যানেলে জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী বলেও জানান।

অন্যদিকে, অ্যাকটিভ মেম্বার্স ইউনিয়ন নামের প্যানেলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন পলি প্ল্যান লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নাছিরুল আলম। ঢাকা অঞ্চলে এই প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন মো. আফজালুল আলম, মো. আবদুল হান্নান মোল্লা, এ কে এম মোস্তফা সেলিম, জিয়াউল ইসলাম, এস এম মালেক, জামিল আহমেদ, মো. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী, পুলক পোদ্দার, মো. আবদুন নুর, মো. সুলতানুল ইসলাম, মীর রায়হান আলী, মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুম, সাইফুল আলম সেলিম, মো. বন্দে আলী মিয়া এবং মো. এনামুল হক। চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই প্যানেলের প্রার্থীরা হলেন, মোহাম্মদ বেলাল, মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরী, মো. আবদুল ওয়াজেদ, মোহাম্মদ এনামুল হক এবং মোহাম্মদ ইকবাল পারভেজ।

অ্যাকটিভ মেম্বার্স ইউনিয়ন প্যানেলের লিডার মো. নাছিরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক বছর পর ভোটাররা খুশি। কারণ, নির্বাচনে অংশ নেওয়া প্রার্থীরা তাঁদের মূল্যায়ন করছেন। আমরা জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী।’

ভোটের মাত্র এক সপ্তাহ আগে ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করে নোটিশ জারি করে নির্বাচন বোর্ড। ঐক্য পরিষদের নেতারা ভোটারদের সুবিধার্থে মধ্য ঢাকায় ভোটকেন্দ্র করার দাবি করেছিল। তবে নির্বাচন বোর্ড ভোটকেন্দ্র হিসেবে বেছে নিয়েছে পূর্বাচলের ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরা (আইসিসিবি)। ওই এলাকার সংসদ সদস্যের ভাই অ্যাকটিভ মেম্বার্স ইউনিয়ন প্যানেলের অধীনে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ফলে ভোট পুরোপুরি সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে কিছুটা হলে সংশয় থেকে যাচ্ছে বলে মনে করেন ঐক্য পরিষদের প্রার্থীরা।

যদিও ভোট সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই বলে মন্তব্য করেন বিজিএপিএমইএর নির্বাচন বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. রাজ্জাকুল ইসলাম। তিনি গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু ভোট করতে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের চেষ্টা করব। এখন পর্যন্ত কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। উভয় প্যানেলই সহযোগিতা করছে।’

মো. রাজ্জাকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘ভোটারেরা পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মোবাইল ফোন জমা দিয়ে ভোট দেবেন। ভোটকক্ষে সিসি ক্যামেরা থাকবে।’