ফ্ল্যাটের বিক্রি কমে গেছে, আসছে না নতুন প্রকল্প

রাজধানীর বুকে একের পর এক আবাসন প্রকল্প গড়ে উঠছেফাইল ছবি

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ঢাকায় ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে। এমনকি অনেক গ্রাহক আগে বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটের কিস্তিও নিয়মিত পরিশোধ করছেন না। এতে ছোট ও মাঝারি আবাসন প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক সংকটে পড়েছে।

এদিকে গত বছরের আগস্টে ঢাকা মহানগরের জন্য নতুন বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপ (২০২২-৩৫ সাল) কার্যকর হওয়ার পর থেকে আবাসন খাতে নতুন প্রকল্পের সংখ্যা কমে গেছে। আগে ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় ভবনের যে আয়তন পাওয়া যেত, সেই তুলনায় এখন পাওয়া যাচ্ছে ৬০ শতাংশ আয়তন। ফলে জমির মালিকেরা আবাসন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রকল্প করতে আগ্রহী হচ্ছেন না।

আবাসন খাতের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান, ড্যাপ কার্যকর হওয়ার পর নতুন করে জমি পাচ্ছে না অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান। ফলে নতুন আবাসন প্রকল্প নিতে পারছে না তারা। এত দিন আগে জমা হওয়া প্রকল্পই পাস হচ্ছিল। বিক্রিবাট্টা কিছুটা হচ্ছিল। তবে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে ফ্ল্যাট বুকিং ও বিক্রি কমে গেছে। অবশ্য বেচাবিক্রির মন্দাভাব নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে না তারা। তাদের বিশ্বাস, দেশে স্থিতিশীলতা এলে বিক্রিও বাড়বে; কিন্তু ড্যাপ সংশোধন করা না হলে বিপদে পড়বে আবাসন খাত।

রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত দুই মাসে ফ্ল্যাটের বিক্রি গড়ে ৩০ শতাংশে নেমেছে। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন ও অফিসের ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছে
আইয়ূব আলী, পরিচালক, রিহ্যাব

জানতে চাইলে রিহ্যাবের পরিচালক আইয়ূব আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে গত দুই মাসে ফ্ল্যাটের বিক্রি গড়ে ৩০ শতাংশে নেমেছে। অনেক ছোট প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বেতন ও অফিসের ভাড়া দিতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে নির্মাণ ব্যয়ের চেয়েও কম দামে এক-দুটি ফ্ল্যাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে কেউ কেউ।’

বিক্রি কেমন কমেছে

২০১৬ সালে যাত্রা শুরু করে আবাসন খাতে শক্ত অবস্থান গড়ে নিয়েছে ক্রিডেন্স হাউজিং। বর্তমানে ধানমন্ডি, লালমাটিয়া, মোহাম্মদপুর, উত্তরা, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকায় তাদের বেশ কিছু প্রকল্প চলমান।

ক্রিডেন্স হাউজিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) জিল্লুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নতুন ফ্ল্যাটের বিক্রি গড়ে ৫০ শতাংশ কমে গেছে। এটি নিয়ে আমরা চিন্তিত না। এটা সাময়িক। দেশের পরিস্থিতির উন্নতি হলে এটা ঠিক হয়ে যাবে। আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ড্যাপ। নতুন ড্যাপের কারণে প্রকল্পের জন্য জমি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রকল্পের নকশা পাস করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ, রাজউকের কর্মকর্তারাই ড্যাপ পুরোপুরি বুঝতে পারছেন না। সে কারণে ড্যাপের সংশোধন প্রয়োজন।

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় আবাসন কোম্পানি বিল্ডিং টেকনোলজি অ্যান্ড আইডিয়াস লিমিটেড (বিটিআই)। ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানি বর্তমানে সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে।

বিটিআইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এফ আর খান প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে ফ্ল্যাটের চাহিদা কমেছে। তবে উচ্চ মূল্যের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটের বিক্রি বেশি কমেছে। অন্যদিকে মাঝারি দামের ফ্ল্যাটের বিক্রি কমেনি; কিছু ক্ষেত্রে বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলে আবাসন খাতের ব্যবসার উন্নতি হবে। টাকার প্রবাহ বাড়লে ফ্ল্যাটের বিক্রিও বাড়বে।

জানা যায়, দেশের ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের একটি অংশ সব সময় আবাসনে বিনিয়োগ করে থাকেন। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ আত্মগোপনে আছেন। অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আবাসনে কালোটাকা বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধ করেছে। ফলে বিশেষ ওই গোষ্ঠী বর্তমানে আবাসনে বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় আছেন।

দেশের আরেক শীর্ষস্থানীয় আবাসন প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, গত দুই মাসে ফ্ল্যাট বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।

দেশের আবাসন খাতে ৩০ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান বিল্ডিং ফর ফিউচার। কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীরুল হক আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গত দুই মাসে ফ্ল্যাটের বিক্রি কমে গেছে। কোনো কোনো গ্রাহক বুকিং দেওয়া ফ্ল্যাটের কিস্তিও দিচ্ছেন না। তবে যাঁরা ব্যাংকঋণ নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন, তাঁদের কিস্তি পাচ্ছি।

তানভীরুল হক বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বিভিন্ন শিল্পকারখানায় হামলা-ভাঙচুর হয়েছে। তৈরি পোশাকশিল্পের পাশাপাশি ওষুধশিল্পেও শ্রম অসন্তোষের ঘটনা ঘটেছে। অন্য ব্যবসা-বাণিজ্য যখন খারাপ যায়, তখন আবাসন খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। দেশে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা এলে আবাসন খাতও হয়তো ঘুরে দাঁড়াবে।

ড্যাপ সংশোধন চায় রিহ্যাব

২০২২-৩৫ সালের জন্য চূড়ান্ত করা ড্যাপ বৈষম্যমূলক ও ত্রুটিপূর্ণ উল্লেখ করে তা সংশোধনের দাবি করছেন রিহ্যাবের নেতারা। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পরামর্শে এরই মধ্যে সংগঠনটি কী কী সংশোধন চায়, সেটির খসড়াও চূড়ান্ত করেছে।

জানতে চাইলে রিহ্যাবের সভাপতি মো. ওয়াহিদুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসন খাতে একধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। এই খাতের ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতি করতে হলে ড্যাপ সংশোধন করতেই হবে। চলতি মাসে ড্যাপ সংশোধন নিয়ে রাজউক চেয়ারম্যানের সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি। তিনি আমাদের কাছ থেকে প্রস্তাব চেয়েছেন। আমরা ২০০৮ সালের ড্যাপের মতো ভবনের উচ্চতা চেয়ে সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত করেছি।’