আটকে গেল পাঁচ ব্যাংকের পাওনা

রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাঁচ ব্যাংক বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) কাছে ৯ হাজার ৩৩৮ কোটি টাকা পাওনা। এর মধ্যে মওকুফযোগ্য ২ হাজার ১২৪ কোটি, আদায়যোগ্য ৭ হাজার ২১৪ কোটি এবং স্থিতি ৭ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকা।

বিএসএফআইসির জন্য সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল স্থিতির ২ শতাংশ অর্থাৎ ১৫৯ কোটি টাকা সংস্থাটি পাঁচ ব্যাংককে এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) দেবে। সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে আরও ২৯৬ কোটি টাকা করে কিস্তি দেবে; কিন্তু শিল্প মন্ত্রণালয় গত ২৪ সেপ্টেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, বিএসএফআইসির পক্ষে এককালীন জমা ও কিস্তি, কোনোটাই পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। যে পাঁচটি ব্যাংক বিএসএফআইসির কাছে টাকা পাবে, সেগুলো হচ্ছে সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, জনতা ও কৃষি ব্যাংক।

চিঠিতে বিএসএফআইসির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারির দাবি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংককে এখন এমন প্রজ্ঞাপন জারি করতে হবে, যাতে এককালীন জমা ও ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধ করা থেকে বিএসএফআইসি ছাড় পায়। এ ছাড়া সুদ মওকুফ করে আদায়যোগ্য টাকার বিপরীতে যেন আর কোনো সুদ আরোপ না করা হয়। সেই সঙ্গে সুদবিহীন ব্লক হিসেবে পুরো টাকা যেন স্থানান্তর করা হয়, সে দাবিও জানিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়।

— বিএসএফআইসির মতো সংস্থাগুলো ভালোভাবে চলেনি বলেই এদের লোকসানের ইতিহাস এত বড়। প্রতি কেজি চিনি ১৬০ টাকায় উৎপাদন করে মাত্র ৬০ টাকায় বিক্রি করা অর্থনীতির কোনো সূত্রের মধ্যেই পড়ে না।
—সেলিম রায়হান, নির্বাহী পরিচালক, সানেম।

জানতে চাইলে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান প্রথম আলোকে বলেন, বিএসএফআইসির মতো সংস্থাগুলো ভালোভাবে চলেনি বলেই এদের লোকসানের ইতিহাস এত বড়। প্রতি কেজি চিনি ১৬০ টাকায় উৎপাদন করে মাত্র ৬০ টাকায় বিক্রি করা অর্থনীতির কোনো সূত্রের মধ্যেই পড়ে না। সংস্থাগুলো পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন এমন সব লোক, যাঁদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো ধারণা থাকে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করলে হয়তো সাময়িক স্বস্তি মিলবে; কিন্তু এভাবে জোড়াতালি দিয়ে সমাধানের চেষ্টা থেকে বের হয়ে স্থায়ী সমাধানের দিকে যেতে হবে।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগের দিন ৪ আগস্ট অবসরে গেছেন বিএসএফআইসির চেয়ারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম। এর আগে ৩০ মে তিনি শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানাকে একটি চিঠি দেন। এতে বলা হয়, চিনিকলগুলোর ব্যাংকঋণের সুদ মওকুফের বিষয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন।

— বিএসএফআইসির ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান শিল্প উপদেষ্টা বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। আশা করছি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শিগগিরই আমাদের অনুরোধের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসবে।
— জাকিয়া সুলতানা, শিল্পসচিব।

শিল্পসচিব ওই নির্দেশনার কথা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের তৎকালীন সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহকে জানিয়েছেন। সলীম উল্লাহ তখন বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের সঙ্গে।

২০২৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর সলীম উল্লাহর সভাপতিত্বে বাংলাদেশ ব্যাংক, পাঁচ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, বিএসএফআইসি ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক হয়। বৈঠকে একটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বন্ড ছেড়ে আদায়যোগ্য টাকা পরিশোধ করার সুপারিশ করে।

এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংক এক মতামতে বলেছে, সুদ মওকুফ করে আদায়যোগ্য টাকার বিপরীতে যেন আর কোনো সুদ আরোপ না করা হয় এবং সুদবিহীন ব্লক হিসেবে যেন পুরো টাকা স্থানান্তর করা হয়, সেই সুযোগ আছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নেওয়ার দরকার নেই। ব্যাংকগুলোর পর্ষদই এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

এর তিন মাস পর গত ৫ মে পাঁচ ব্যাংককে চিঠি দেয় বিএসএফআইসি। এসব কথা শেখ শোয়েবুল আলমের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, সোনালী, জনতা ও কৃষি ব্যাংক লিখিতভাবে সংস্থাটিকে জানায় যে এককালীন জমা ও ত্রৈমাসিক কিস্তি পরিশোধসহ পূর্ণাঙ্গ প্রস্তাব দাখিল করতে হবে। একই কথা সংস্থাটিকে মৌখিকভাবে জানায় অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক।

বিএসএফআইসির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ শোয়েবুল আলম সম্প্রতি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক আগের ঘটনা। যত দূর মনে পড়ে, আগের প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক নির্দেশনাটি ছিল ওই সময়ের শিল্পমন্ত্রী ও শিল্পসচিবের প্রতি। এ নিয়ে অনেক চিঠি লেখালেখি হলেও কোনো কাজ হয়নি।’

তখনকার শিল্পসচিব জাকিয়া সুলতানা এখনো একই দায়িত্বে আছেন। সম্প্রতি যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, মন্ত্রিসভার কোনো একটি বৈঠকের পর তাঁকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মৌখিক নির্দেশনাটি দিয়েছিলেন। তখন সে সময়ের শিল্পমন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। জাকিয়া সুলতানা বলেন, কাহিনি অন্য জায়গায়। উৎপাদন খরচের চেয়ে অনেক কমে চিনি বিক্রি করতে হয় বলেই বিএসএফআইসির এমন দশা হয়েছে। এটা একটি নীতি–সমস্যা। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ প্রজ্ঞাপন জারি করলেই সংস্থাটির আপাতমুক্তি মিলবে।

শিল্পসচিব আরও বলেন, ‘বিএসএফআইসির ঋণের পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমান শিল্প উপদেষ্টা (আদিলুর রহমান খান) বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। আশা করছি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে শিগগিরই আমাদের অনুরোধের পক্ষে সিদ্ধান্ত আসবে।’