৩১৩ থেকে ৪৬ হাজার কারখানা

যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শিল্প খাত নিয়ে ১৯৭৩ সালের প্রথম বার্ষিক পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় একটি মূল্যায়ন করা হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে কারখানা ভবন নির্মাণ
ছবি: প্রথম আলো

স্বাধীনতার পর দেশে শিল্পকারখানা ছিল না বললেই চলে। মাত্র ৩১৩টি কারখানা নিয়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিতে শিল্প খাতের যাত্রা শুরু হয়। তখনকার হিসাব অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের সময় এ দেশের শিল্প খাতে প্রায় ২৯ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। তবু ওই সময় সরকারের নানা উদ্যোগে খাতটি ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা নিয়ে সংকটের পাশাপাশি ঋণের অপর্যাপ্ততা ও দক্ষ জনবলের সংকটও ছিল প্রবল। সরকারি বিভিন্ন পুরোনো দলিল ঘেঁটে এ চিত্র পাওয়া গেছে।

আশার কথা হলো, সেই দেশটিতে গত পাঁচ দশকে বিশাল এক উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ী শ্রেণি গড়ে উঠেছে। দেশীয় বাজারের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি বাজারেও পণ্যের তালিকা বড় হয়েছে। এককথায়, গত ৫০ বছরে ব্যাপকভাবে শিল্প খাতের বিকাশ ঘটেছে। শিল্পকারখানার সংখ্যা প্রায় দেড় শ গুণ বেড়েছে। বদৌলতে উৎপাদনমুখী কলকারখানার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ হাজার ১১০টি। এর মধ্যে বৃহৎ কারখানা প্রায় তিন হাজার। এগুলো হচ্ছে এখন শিল্প খাতের মেরুদণ্ড।

গত ৫০ বছরে শিল্প খাতে ব্যাপক সাফল্য অর্জিত হয়েছে। এর অন্যতম উদাহরণ হলো বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চামড়াজাত পণ্যেও বিশ্ববাজারে বেশ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করছে বাংলাদেশ। পুরোনো ইতিহাসের পথ ধরে পাট ও পাটপণ্যের দিন সোনালি দিন আবার ফিরে আসছে। বর্তমানে পাট উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। এ দেশে ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনের দ্বারও খুলে গেছে। দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই এখন ফ্রিজ, এসি, মোবাইল ফোনের মতো অতি প্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বানাচ্ছে।

শিল্প খাতে আমরা কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় আছি তা সাদা চোখে তাকালেই দেখতে পারি। সরকার শিল্পনীতির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়েছে। আবার উদ্যোক্তারাও নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পেরেছেন
— আবুল কাসেম খান, পরিচালক, এ কে খান গ্রুপ।

ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি ও এ কে খান গ্রুপের পরিচালক আবুল কাসেম খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিল্প খাতে আমরা কোথায় ছিলাম, এখন কোথায় আছি তা সাদা চোখে তাকালেই দেখতে পারি। সরকার শিল্পনীতির মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিয়েছে। আবার উদ্যোক্তারাও নিজেদের দক্ষ করে তুলতে পেরেছেন। তাই আমরা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হতে পেরেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের উদ্যোক্তাদের এখন বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে কাজ করার সুযোগ দেওয়া উচিত।’

শুরুটা সহজ ছিল না

স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের নভেম্বর মাসে পরিকল্পনা কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। ওই পরিকল্পনায় যুদ্ধের সময়ে শিল্প খাত কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এরপর কীভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা চলে, তার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরা হয়।
স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে এ দেশে ১৯৬৮-৬৯ সালে নিবন্ধিত শিল্পকারখানার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ১৩০। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৭৯১টি প্রতিষ্ঠান ছিল বস্ত্র খাতে। এ ছাড়া অনিবন্ধিত কারখানাও ছিল।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা দলিলে ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময়ে শিল্প খাতের সার্বিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করে বলা হয়, বিপুলসংখ্যক কারখানা ভবন ধ্বংস হয়েছে, যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যানবাহন, কাঁচামাল ও গুদামঘর। এসব সম্পদ পুনঃস্থাপন করা হলে সব মিলিয়ে তখনকার হিসাবে ২৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা খরচ করতে হতো বলে পরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়। এ ক্ষতির মধ্যে সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন শিল্পকারখানাগুলোর অংশ ছিল ২২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। বাকি ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা ক্ষতি হয় বেসরকারি খাতে।

ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা

স্বাধীনতার পর দেশের শিল্প খাত নানামুখী সমস্যায় পড়ে। যাহোক, শিল্পের মালিকানায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। যেসব কলকারখানার মালিক ছিলেন পাকিস্তানি, তাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই সেগুলোর মালিকানা নেয় রাষ্ট্র। বিশেষ করে পাট, বস্ত্র ও চিনিকলগুলো রাষ্ট্রমালিকানাধীন করা হয়। শিল্পকারখানাগুলোর জন্য ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ রাষ্ট্রমালিকানাধীন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। শিল্প খাতকে ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সহায়তা করতে এ কর্মসূচি নেওয়া হয়। সেনাকল্যাণ সংস্থা এবং মুক্তিযোদ্ধা ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনকে কিছু কিছু কারখানা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সার্বিকভাবে তখন সরকারের হাতে শিল্পকারখানার স্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১৭ কোটি টাকা। ১৯৭৩ সালের ৩০ জুনের হিসাব অনুযায়ী ৩১৩টি কারখানা নিয়ে দেশের শিল্প খাতের যাত্রা শুরু হয়। এটি শুধু সরকারের হাতে থাকা শিল্পকারখানার সংখ্যা। বেসরকারি খাতে তখনো তেমন শিল্প প্রতিষ্ঠান ছিল না।

ওই সময়ে শিল্প খাতকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে নানা সমস্যার কথা তুলে ধরা হয় প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এতে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রায়ত্তকরণের ফলে পাট ও বস্ত্র খাতে দক্ষ জনবল ও ব্যবস্থাপকের সংকট দেখা দেয়। শিল্প খাতে ব্যবস্থাপকের পাশাপাশি অর্থনৈতিক বিশ্লেষক, হিসাববিদ এবং বিপণন বিশেষজ্ঞেরও অভাব দেখা দেয়। তখন শিল্প খাতের পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় শ্রম অসন্তোষ ও শ্রমিকদের উদ্বুদ্ধ করতে না পারা বড় বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

এ ছাড়া শিল্পের কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য ও ভোগ্যপণ্য—সবই পাকিস্তান থেকে আমদানি করা হতো। কিন্তু স্বাধীনতার পর এসব পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক করা যায়নি। এর ওপর বিদ্যুতের সংকটও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু রাস্তাঘাট ও সেতু ধ্বংস হওয়ার কারণে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে পণ্যের চলাচল বিঘ্নিত হয়।

স্বাধীনতার পর আরেকটি বড় সমস্যা দেখা যায়, এ দেশের উদ্যোক্তাদের ঋণ দেওয়ার চ্যালেঞ্জ। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়, এ দেশের বেশির ভাগ উদ্যোক্তার তখন ব্যবসা পরিচালনার জন্য চলতি মূলধন দরকার ছিল। টাকার অভাবে অনেকে কাঁচামাল আমদানি করতে পারছিলেন না। কিছু চলমান উন্নয়ন প্রকল্প স্থগিত করা হয়। দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তখনো নিজেদের ভূমিকা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা ছিল না। তারা কীভাবে ঋণ দেবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার নির্দেশনাও ছিল না।
এভাবেই নানা সংকটের মধ্য দিয়ে শিল্প খাতের যাত্রা শুরু হয়। তবে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত এ দেশে শিল্প খাতের তেমন বিকাশ ঘটেনি। যে কারণে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) শিল্প খাতের অবদান ১০ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে।

নব্বইয়ের দশকে অর্থনীতি উন্মুক্ত তথা উদারীকরণের নীতি নেওয়া হয়। চালু করা হয় বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নানা সুবিধা প্রদানের নীতি। মূলত শিল্প স্থাপনে কর অবকাশ ও রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনাসহ নানা সুবিধার প্রচলন এবং ব্যাংকঋণপ্রাপ্তি সহজ করা হয়। এ ধরনের নানা সুযোগ–সুবিধার ফলে দেশে গত তিন দশকে বিরাট এক উদ্যোক্তা শ্রেণি গড়ে উঠেছে, যা লাখ লাখ অদক্ষ ও আধা দক্ষ নারী-পুরুষের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রেখেছে। এর পাশাপাশি গত তিন দশকে মোবাইল ফোন, পরিবহন, স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সেবা খাতের বিকাশ ঘটেছে। বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিও দেশে বিনিয়োগ করেছে।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, স্বাধীনতার পর শিল্প খাতের উন্নয়নে মূলত চারটি কারণ প্রভাব ফেলেছে। সেগুলো হলো—আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাণিজ্য সুবিধা, শ্রমশক্তির প্রাপ্যতা, উদ্যোক্তা শ্রেণির আগ্রহ ও সরকারি নীতি। সাধারণত পোশাক উৎপাদন দিয়েই একটি দেশে শিল্পবিপ্লব শুরু হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তা–ই হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুবিধা (কোটা সুবিধা) নিয়ে ১৯৮০-এর দশকে দেশের পোশাকশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এ দেশে তখন পোশাক শিল্পের জন্য পর্যাপ্ত শ্রমিকও মেলে। বিশেষ করে নারীরা আগে ঘর থেকে বেরোতেন না, ওই সময় তাঁরা পোশাকশিল্পে শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে আসেন।

জাহিদ হোসেন আরও বলেন, স্বাধীনতার আগে পাকিস্তান আমলে এ দেশের উদ্যোক্তারা তেমন নীতি সুবিধা পেতেন না। স্বাধীনতার পর সেই বাধা দূর হয়। উদ্যোক্তার অভাব এ দেশে কখনোই হয়নি। সরকার বিভিন্ন নীতি সহায়তা দিয়েছে, উদ্যোক্তারা যা কাজে লাগিয়েছেন।