তৈরি পোশাক ও বস্ত্রকলমালিকদের সমঝোতা, বাড়ছে না সুতার দাম
রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের চাপে অবশেষে সুতার দাম নিয়ে সমঝোতা করতে রাজি হয়েছেন বস্ত্রকলমালিকেরা। এ কারণে নতুন করে আপাতত সুতার দাম এক সেন্টও বাড়বে না, যত দিন না সুতার সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণে কমিটি হয়। চার ব্যবসায়িক সংগঠন বিটিএমএ, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর নেতাদের সমন্বয়ে একটি কমিটি হবে। তারা বিশ্ববাজারে তুলার মূল্য বাড়লে সুতার সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করবে।
সুতার বাড়তি দাম নিয়ে হঠাৎ পোশাক ও বস্ত্র খাতের মালিকেরা মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেলে সমস্যা নিরসনে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীদের মধ্যস্থতায় গতকাল মঙ্গলবার রাতে এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়। রাজধানীর বনানীর একটি রেস্তোরাঁয় অনুষ্ঠিত বৈঠকে বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএ, তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ এবং বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিটিএলএমইএ) নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
জানা যায়, গতকাল রাতের বৈঠকে স্কয়ার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান তপন চৌধুরী, নিউ এশিয়া গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মতিন চৌধুরী, এনভয় গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ, হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ কে আজাদ, বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী, সহসভাপতি ফজলুল হক, বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান, পরিচালক তানভীর আহমেদ, বিকেএমইএর সভাপতি এ কে এম সেলিম ওসমান, সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম, বিটিটিএলএমইএর চেয়ারম্যান এম শাহদাৎ হোসেন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে তপন চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলী অনলাইনে অংশ নেন।
বৈঠক অংশ নেওয়া তিন সংগঠনের তিনজন নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা জানান, সভায় বস্ত্রকল মালিকেরা বাড়তি সুতার দামের যৌক্তিকতা তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তবে পোশাকশিল্পের মালিকেরাও পাল্টা যুক্তি দিতে থাকেন। বিকেএমইএর একজন নেতা বস্ত্রকল মালিকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের সহযোগিতার জন্যই আজকে আপনারা এই অবস্থানে এসেছেন, ছোট থেকে বিশাল শিল্পের মালিক হয়েছেন। আপনারা যদি মনে করেন, আমাদের মেরে আপনারা বড় হবেন, তাহলে ভুল করবেন। আমরা মরলে আপনাদের নিয়েই মরব।
আলোচনার একপর্যায়ে একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী সুতার সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। বস্ত্রকল মালিকেরা আগামী সপ্তাহে আরেকটি বৈঠক করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন। তবে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএ নেতারা সময় দিতে রাজী না হওয়ায় সমঝোতা করতে বাধ্য হোন বস্ত্রকল মালিকেরা। শেষে সুতার দাম নিয়ে একাধিক সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে বিটিটিএলএমইএর চেয়ারম্যান এম শাহদাৎ হোসেন বলেন, সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের তুলার দামকে ভিত্তি ধরে আমদানি ও উৎপাদন ব্যয়সহ অন্যান্য খরচ হিসাব করে সুতার সর্বোচ্চ দাম নির্ধারণ করা হবে। তার চেয়ে বেশি দামে কেউ সুতা বিক্রি করতে পারবে না। তবে কমে বিক্রি করা যাবে। আর দাম নির্ধারণের জন্য বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর ২ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে একটি কমিটি করবে বিটিএমএ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী বলেন, কমিটি না হওয়া পর্যন্ত সুতার দাম বাড়ানো হবে না। তুলার দাম বৃদ্ধি পেলে সুতার নতুন দাম নির্ধারণ হবে। আগামী সপ্তাহে এ সংক্রান্ত কমিটি চূড়ান্ত করা হবে। এ ছাড়া আপাতত সুতার অফার দাম সাত দিনের পরিবর্তে ১৫ দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মানে হচ্ছে, কোনো ক্রেতা স্পিনিং মিলের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সুতার দামের যে কোটেশন নেবেন সেই দামেই পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে ক্রয়াদেশ দিতে পারবেন।
আট মাস ধরে সুতার দাম বাড়তি। মাঝে এপ্রিল-মে মাসে বাজার ছিল অস্থির-প্রায় প্রতিদিনই সুতার দাম বাড়ছিল। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি না থাকলেও দাম বেশি। পোশাকের কাপড় তৈরিতে বেশি ব্যবহৃত ৩০ কাউন্টের প্রতি কেজি সুতা ৪ ডলার ২৫ সেন্ট থেকে ৪ ডলার ৪০ সেন্টে বিক্রি হচ্ছে। গত নভেম্বরে দাম ছিল ৩ ডলারের কম। তবে হঠাৎ সুতার বাড়তি দাম নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান চলে যান পোশাক ও বস্ত্র খাতের মালিকেরা।
পোশাকশিল্পের মালিকদের অভিযোগ, চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় স্পিনিং মিলগুলো অন্যায্যভাবে সুতার দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। সে জন্য কারখানাগুলো পোশাকের ক্রয়াদেশ নিতে হিমশিম খাচ্ছে। অন্যদিকে বস্ত্রকল মালিকদের দাবি, আন্তর্জাতিক বাজারে তুলার দাম বাড়তি। করোনার কারণে কনটেইনার ভাড়াও চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। তা ছাড়া মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এককভাবে সুতার দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই।
জানা যায়, সুতার দাম নিয়ে কয়েক মাস ধরেই বিপদে ছিলেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় গত মাস থেকে প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। তবে সুতার বাড়তি দামে ক্রয়াদেশ নিতে ক্রেতাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে সুবিধা করতে পারছেন না মালিকেরা। অনেক ক্রেতাই পোশাকের বাড়তি দাম দিতে রাজি হচ্ছে না। আবার সুতার বাজার অস্থির থাকায় নতুন করে দাম বাড়লেও বিপদে পড়বেন পোশাক মালিকেরা।
বিজিএমইএর গুলশান কার্যালয়ে গত রোববার বিজিএমইএ, বিকেএমইএ ও বিটিটিএলএমইএর নেতারা বৈঠক করেন। এতে নেতারা বলেন, স্পিনিং মিলগুলো সুতার দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে, যা এককথায় অসহনীয়। সুতার মূল্য বৃদ্ধিতে কী কী সমস্যা হচ্ছে, সেসব তুলে ধরতে মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করার সিদ্ধান্ত হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিটিএমএর নেতারা সোমবার নিজেদের অবস্থান জানাতে সভা ডাকেন। পরে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের হস্তক্ষেপে দুই পক্ষই কর্মসূচি বাদ দিয়ে সমঝোতার টেবিলে বসার সিদ্ধান্ত নেন।
বিটিএমএর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী নিট পোশাক কারখানার চাহিদার ৮০ শতাংশ সুতার জোগান দেয় দেশীয় স্পিনিং মিলগুলো। ওভেন পোশাক কারখানার ক্ষেত্রে সেটি ৩৫-৪০ শতাংশ। ২০১৯ সালে স্পিনিং মিলগুলো ৩০৬ কোটি ডলার মূল্যের ১০ লাখ টন সুতা রপ্তানিকারকদের সরবরাহ করেছে। করোনার কারণে গত বছর সেটি কমে ৫ লাখ ৬৯ টনে দাঁড়ায়, যা অর্থের হিসাবে ২৭৮ কোটি ডলার।