গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে সরকারের প্রক্রিয়ায় দুশ্চিন্তায় আছেন বস্ত্র, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ীরা। সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতি ও ব্যবসাবান্ধব করকাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাবও দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন দি ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ও আরটিভির যৌথ আয়োজন ‘বাজেট প্রত্যাশা ২০২২-২৩’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন তাঁরা। গতকাল বুধবার রাতে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠানটি হয়। সভাপতিত্ব করেন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন।
বিভিন্ন খাতের ব্যবসায়ী নেতারা জানান, করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে একধরনের মূল্যস্ফীতির চাপ আছে। এ সময় আসন্ন বাজেটে সরকারকে কৌশলী হতে হবে। বিদ্যুৎ-জ্বালানির ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো যাবে না। জ্বালানির দাম বাড়লে শিল্পায়ন বাধাগ্রস্ত হবে, প্রবৃদ্ধি থেমে যাবে। এ ছাড়া বছর বছর করকাঠামো পরিবর্তন না করে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো গড়ে তোলার প্রস্তাব দেন তাঁরা।
জ্বালানি খাত নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কারখানা অভিযোগ করেছে, তারা গ্যাস পাচ্ছে না। এ অবস্থা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে দ্রুত এলএনজি আমদানি করতে হবে।মোহাম্মদ হাতেম, নির্বাহী সভাপতি, বিকেএমইএ
ব্যবসায়ীরা আরও বলেন, আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষি, মৎস্য ও হালকা প্রকৌশলশিল্পের মতো খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব খাতে প্রয়োজনীয় নীতি সুবিধা ও প্রণোদনা নিশ্চিত করতে হবে। ভারী শিল্পের ক্ষেত্রে করপোরেট কর হ্রাস করা নিয়ে সরকারকে বিশেষভাবে ভাবতে হবে।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘জ্বালানি খাত নিয়ে আমরা আতঙ্কে আছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু কারখানা অভিযোগ করেছে, তারা গ্যাস পাচ্ছে না। এ অবস্থা কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে বিদেশ থেকে দ্রুত এলএনজি আমদানি করতে হবে।’ শিল্পায়নে গ্যাস-বিদ্যুৎ অপরিহার্য বিধায় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের পাশাপাশি দাম স্থিতিশীল রাখার আহ্বান জানান তিনি।
বস্ত্রকলমালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর খবরে অন্যান্য খাতের মতো বস্ত্র খাতের ব্যবসায়ীরাও আতঙ্কিত। এ খাতে বিদ্যুতের ব্যবহার অনেক বেশি। সুতরাং দাম বাড়ানো হলে আমাদের জন্য টিতে থাকা চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাবে।’
অতিরিক্ত করের চাপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে করের জাল বাড়াতে হবে। এখন কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়, সেটা ভাবতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ পড়বে।ফাহমিদা খাতুন, সিপিডি, নির্বাহী পরিচালক
শিল্পবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম যাতে না বাড়ে, সরকারকে সে ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন এফবিসিসিআইর সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘শিল্পায়ন থমকে গেলে দেশের প্রবৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। আমরা বরাবরের মতো এ বাজেটেও দীর্ঘমেয়াদি করকাঠামো ও জ্বালানি নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, অতিরিক্ত করের চাপ থেকে মুক্তি পেতে চাইলে করের জাল বাড়াতে হবে। এখন কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়, সেটা ভাবতে হবে। তা না হলে মূল্যস্ফীতির পাশাপাশি প্রবৃদ্ধির ওপর চাপ পড়বে। বাজেটে নিম্ন আয়ের মানুষ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দরিদ্র মানুষদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি ও কৃষির ওপর থেকে ভর্তুকি কমানো যাবে না।
আমরা কৃষি উৎপাদন ধরে রাখার সম্ভাব্য চেষ্টা করব। সারের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে জ্বালানির ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে।আব্দুর রাজ্জাক, কৃষিমন্ত্রী
ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়ে অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বাজেট নিয়ে আজকের অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ-জ্বালানিসহ যেসব সুপারিশ ও প্রস্তাব এসেছে, সেগুলো প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে। এগুলো সরকারের কাছে যাওয়া দরকার। এখানে শুধু বড় ব্যবসায়ী নন, ক্ষুদ্র ও কুঠির শিল্প, হালকা প্রকৌশল শিল্প, কৃষি খাতসহ সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার কথা এসেছে। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই তবে বাজেট করতে হবে।
কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ‘আমরা কৃষি উৎপাদন ধরে রাখার সম্ভাব্য চেষ্টা করব। সারের দাম বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে জ্বালানির ব্যাপারে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে হবে। কৃষিসহ অন্যান্য খাতে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়ার ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ চলমান।’
আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে তখন আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবুও সরকার চেষ্টা করছে, পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে। ইতিমধ্যে সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে বাজার অনেকটা স্থিতিশীল।টিপু মুনশি, বাণিজ্যমন্ত্রী
কর্মসংস্থানে এখন কৃষির চেয়ে শিল্পায়নের দিকে মনোনিবেশ করা জরুরি বলে মন্তব্য করে আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কৃষি উৎপাদন যেখানে গেছে, তা সন্তোষজনক। এটা ধরে রাখতে হবে। বর্তমানে কৃষির চেয়ে কর্মসংস্থানের জন্য এখন হালকা প্রকৌশল শিল্পে নজর দেওয়া জরুরি। এটা সম্ভাবনাময় খাত।
আগামী অর্থবছরের বাজেট চ্যালেঞ্জিং হবে উল্লেখ করে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে গেলে তখন আমাদের তেমন কিছু করার থাকে না। তবুও সরকার চেষ্টা করছে, পণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে। ইতিমধ্যে সরকারের কিছু পদক্ষেপের কারণে বাজার অনেকটা স্থিতিশীল। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আগাতে চাইলে আমাদের আরও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রণোদনা লাগলে দিতে হবে।’