গ্যাস ও বিদ্যুৎ–সংকটে শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত
টাইলসের বাজারে দেশের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান আরএকে সিরামিকস। গ্যাস–সংকটে দুইভাবে ভুগছে প্রতিষ্ঠানটি। নিজেদের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে তাদের। তবে গ্যাস–সংকটের কারণে প্রতিষ্ঠানটির চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। একই সঙ্গে গ্যাসের প্রয়োজনীয় চাপ না থাকায় টাইলস উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে আরএকে সিরামিকসের কোম্পানি সচিব মুহাম্মদ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ধ্যার পর থেকে গ্যাসের চাপ কমতে থাকে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত গ্যাসের যে চাপ থাকে, তা চাহিদার তুলনায় অনেক কম। বর্তমান অবস্থা অব্যাহত থাকলে বিকল্প কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তা নিয়ে আমরা ইতিমধ্যে চিন্তাভাবনা শুরু করেছি।’
ইস্পাত খাতের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের বিএসআরএম গ্রুপ। বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানটির রড উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাস নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছে না। তবে বিদ্যুৎ–স্বল্পতার কারণে আমাদের রড উৎপাদন সক্ষমতার ৬০ শতাংশ ব্যবহার করতে পারছি আমরা।’
আরএকে সিরামিকস ও বিএসআরএমের মতো দেশের অনেক শিল্পকারখানার উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে গ্যাস–বিদ্যুতের সংকটে। শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোও কমবেশি সমস্যায় পড়েছে। রপ্তানিকারকেরা বলছেন, গ্যাস–বিদ্যুতের পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে খুব বেশি দিন সময় লাগবে না।
এদিকে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের পাওয়ার, এনার্জি অ্যান্ড ইউটিলিটিজবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির তৃতীয় সভা গতকাল অনুষ্ঠিত হয়। এতে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, দেশব্যাপী লোডশেডিংয়ের প্রভাবে শিল্পকারখানার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। নিরবচ্ছিন্ন শিল্পোৎপাদনের জন্য কারখানায় বিদ্যুতের জোগান নিশ্চিত করা জরুরি। সংকট মোকাবিলায় বিদ্যুতের রেশনিং ব্যবস্থা চালুর পরামর্শ দেন তিনি।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরবরাহ–সংকট থাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। বিশ্ববাজারে দাম চড়া, তাই খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে আপতত তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার।
সিলেটের ছাতককেন্দ্রিক বহুজাতিক একটি সিমেন্ট কোম্পানিকে সম্প্রতি চিঠি দিয়ে মিতব্যয়ী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছে ওই কোম্পানির কারখানায় গ্যাস সরবরাহকারী একটি সংস্থা। এমন চিঠি পাওয়ার পর কোম্পানিটি বিকল্প উৎস থেকে গ্যাসের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বলে কোম্পানিটির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ইউক্রেন–রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য ও জ্বালানির দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যায়। তাতে আমদানি খরচও বেড়েছে। সেই সঙ্গে প্রবাসী আয় কমে যাওয়ায় ডলার–সংকট প্রকট হয়। তবে রপ্তানি আয়ে এক ধরনের স্বস্তি ছিল। বিদায়ী ২০২১–২২ অর্থবছরে ৫ হাজার ২০৮ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় দেশে এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৪ শতাংশ বেশি।
নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের ফকির ফ্যাশনের ডায়িংয়ে প্রতিদিন ৬০–৬৫ টন কাপড় রং করা হয়। গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকটে সেই উৎপাদন ৩০–৩৫ টনে নেমে গেছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুজ্জামান নাহিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘দেশে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে পোশাকের দোকানে বিক্রি কমে গেছে। সে কারণে ক্রয়াদেশ কমতির দিকে। তার মধ্যে গ্যাস–সংকটের কারণে উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে কমে গেলে লোকসান গুনতে হবে আমাদের।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাসের ঘাটতি এখন চাহিদার তুলনায় ৮–১০ শতাংশ বলে দাবি করছে পেট্টোবাংলা। অথচ বাস্তবে ঘাটতি তারও বেশি।
জানতে চাইলে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনের বেলায় গ্যাসের চাপ ২–৩ পিএসআইয়ের বেশি পাওয়া যাচ্ছে না। কেবল রাত ১১টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত গ্যাসের চাপ যথাযথ পাচ্ছি। লোডশেডিংও বেড়ে গেছে। দিনের বেলাতেই ৩–৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ পাচ্ছি না আমরা। এ কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। সময়মতো পোশাক উৎপাদন করতে না পারায় রপ্তানিমূল্যও পাচ্ছি না।’
পোশাক খাতের মধ্যে গ্যাসের ব্যবহার বেশি হয় বস্ত্র খাতে তথা টেক্সটাইলে। এ খাতের কারখানাগুলো বেশি ভুগছে গ্যাস–সংকটে।
জানতে চাইলে বস্ত্রকল মালিকদের সংগঠন বিটিএমএর সভাপতি মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার ও গাজীপুরের বস্ত্রকলগুলো গ্যাস–সংকটে বেশি ভুগছে। দিনের অধিকাংশ সময় গ্যাসের চাপ না থাকায় ২০–৬০ শতাংশ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য রপ্তানি জাহাজীকরণে ব্যর্থ হচ্ছে অনেক রপ্তানিকারক। তিনি বলেন, এলএনজি দেওয়ার কথা বলে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এখন সেই এলএনজি নিয়মিত আমদানি করা হচ্ছে না। গ্যাস–সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে শিল্প খাত ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়বে।
(প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম ও প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ )