বাজার খরচে কাটছাঁট, ঘাটতি বাড়ছে পুষ্টির
কোনো একদিন যদি খাসির মাংস খাওয়ার ইচ্ছা হয়, তাহলে এক কেজি কিনতে মানিব্যাগ থেকে বের করতে হবে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকার মতো। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই হয়তো দেশের অনেক মানুষেরই খাসির মাংস খাওয়ার বিলাসিতা চলে যাবে। কারণ, এই টাকা দিয়েই ২০ কেজি স্বর্ণা চাল কেনা যায়, যা দিয়ে অনেকেই মাসের অর্ধেকটা সময়ে অন্তত পেটভরে ভাত খেতে পারবে।
খাসির পরিবর্তে গরুর মাংসের কথা ভাবলেও কিন্তু খুব একটা সুবিধা হচ্ছে না। এর দরও বেড়ে গেছে, প্রতি কেজির জন্য ক্রেতাকে গুনতে হচ্ছে ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা। তাহলে মুরগির কথা ভেবে দেখবেন হয়তো অনেকে। কিন্তু কয়েক দিনে সেই মুরগির দামও বেড়ে কেজি ২০০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তাহলে কি কেবলই ডিম? এখানেও দুঃসংবাদ, এরও দাম বাড়ছে। প্রোটিন বা আমিষ সাম্রাজ্যে বাকি আছে মাছ। তবে এ জন্য বেছে নিতে হবে তেলাপিয়া বা চাষের পাঙাশ মাছ।
এর দাম বাড়লেও এখনো কিছুটা নাগালের মধ্যে। এখানে আমিষের আরেক উৎস দুধের কথা সীমিত আয়ের মানুষের মধ্যে আলোচনা না ওঠানোই ভালো, কারণ এখানেও কোনো সুসংবাদ নেই।
সব মিলিয়ে দ্রব্যমূল্যের চাপে সীমিত আয়ের মানুষ এখন বাজার খরচ কাটছাঁট করছেন। কমেছে আমিষজাতীয় পণ্যের কেনাবেচা। আর তাতে পুষ্টির ঘাটতি আরও বেড়ে যাচ্ছে।
সব আমিষের দামই বাড়তি
ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাব বলছে, এক মাস আগে ঢাকার বাজারে এক কেজি গরুর মাংসের দাম ছিল ৬৬০ থেকে ৭০০ টাকা। আর খাসির মাংসের দাম ছিল ৯০০ থেকে ১ হাজার টাকা। সেই খাসির মাংসের দাম বেড়েছে কেজিতে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। আর এক মাসের ব্যবধানে বাজারে কেজিতে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকার মতো। গরুর মাংসের কেজি এখন ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা।
রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বিসমিল্লাহ মাংস বিতানের বিক্রেতা শামীম আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, গত চার থেকে পাঁচ দিনে মাংসের দাম কেজিতে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছে। তবে এখনো ক্রেতাভেদে দাম কমবেশ করে বিক্রি করছেন। উৎপাদন খরচ সমন্বয় করতে গিয়ে কৃষকেরা গরুর দাম বেশি রাখছেন। তাতে সামনে দাম আরও বাড়তে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ঢাকার বাজারে শুধু যে গরু ও খাসির মাংসের দাম বেড়েছে তা–ই নয়, ফার্মের মুরগি, ডিম, দুধ ও মাছের মতো সব ধরনের প্রোটিনজাতীয় খাবারের দাম চড়া। যেমন গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর পশ্চিম রামপুরার বাসিন্দা আবদুর রহমান স্থানীয় রামপুরা বাজারে তেলাপিয়া মাছের দরদাম করছিলেন। তাঁর কাছে বড় আকারের তেলাপিয়া মাছের দাম চাওয়া হয় কেজিপ্রতি ২৫০ টাকা। দরদাম করে তিনি সেই তেলাপিয়া মাছে কিনলেন ২২০ টাকা কেজিতে। প্রায় একই দামে পাঙাশ মাছও বিক্রি হতে দেখা গেছে।
বাজার করার সময় আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে মাংসের দাম বেশ চড়া হওয়ায় মাছ কিনতে এসেছিলাম। কিন্তু খুব একটা সুবিধা হলো না। কম দামি মাছের দামও কেজিপ্রতি ২০০ টাকার নিচে নেই। ডিমের দামটা একটু কম ছিল, সেটাও বাড়তি। এতে কিছু একটা কিনতে এখন বেশ হিসাব করতে হচ্ছে। চাপিয়ে খরচ করেও কাটছাঁট করতে হচ্ছে প্রায় সব খাবারে।’
আমিষের সবচেয়ে সস্তা উৎস ফার্মের মুরগির বাদামি রঙের ডিমের ডজন এখন ১৪০ টাকার আশপাশে। এক মাস আগেও প্রতি ডজন ডিমের দাম ছিল ১১০ থেকে ১১৫ টাকা। সাধারণ মানুষের প্রোটিনের বড় আরেকটি উৎস ব্রয়লার মুরগি। কেজিপ্রতি ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ২০০ থেকে ২১০ টাকা। টিসিবি বলছে, মাসখানেক আগেও প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হয়েছে ১৪৫ থেকে ১৬০ টাকার মধ্যে। কম নেই সোনালি মুরগির দামও। কেজিপ্রতি ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়ে এখন ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি মুরগি বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি ৪৫০ থেকে ৫৫০ টাকার মধ্যে।
মালিবাগ বাজারের মুরগি ব্যবসায়ী মো. ইমন প্রথম আলোকে বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম হঠাৎ করে সপ্তাহ ব্যবধানে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেড়ে গেছে। বাজারে মুরগির সরবরাহ একটু কম। দামের এ অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে বেচাকেনা কমে এসেছে।
আমিষের আরেক উৎস দুধ। বাজারে তরল ও গুঁড়া এ দুই প্রকারের দুধ পাওয়া যায়। এর মধ্যে গত বছরে কয়েক দফায় দুধের দাম বেড়েছে। তরল দুধের দাম গত এক বছরে লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেড়েছ। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) এক লিটার দুধের দাম এখন ৯০ টাকা। টিসিবির হিসাবে গত এক বছরে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্যাকেটজাত গুঁড়া দুধের দাম বেড়েছে ২৭ থেকে ৩৫ শতাংশ।
দাম বেড়ে সেখানে এখন স্থিতিশীল
বাজারে চালের দাম এখনো উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল। সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাব বলছে, গত এক মাসে মোটা চালের দাম ২ বেড়েছে শতাংশের ওপরে। আর সরু ও মাঝারি চালের দাম বেড়েছে দেড় ও ২ শতাংশের মতো। সামনে আসছে রমজান। এই সময়ে বাজারে ছোলা ও মসুর ডালজাতীয় খাবারের চাহিদা বাড়ে। রমজানে ভোজ্যতেলের চাহিদাও বেশি থাকে। এসব পণ্যের দাম বাজারে উচ্চ মূল্যে স্থিতিশীল হয়ে আসে। মানভেদে মসুর ডালের দাম পড়ছে কেজিপ্রতি ১০০ থেকে ১৪০ টাকা। আর সয়াবিন তেল লিটার প্রতি সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম ১৯০ টাকাতেই বিক্রি হচ্ছে।
তবে বাজারে সরবরাহ ভালো থাকায় এখন নাগালের মধ্যে চলে এসেছে শীতের সবজির দাম। লাউ ও কুমড়ার মতো সবজির দাম একটু বেশি হলেও অন্যান্য প্রায় সব ধরনের সবজির দাম কেজিপ্রতি ৫০ টাকার মধ্যে। টমেটো, শসা ও গাজরের দাম কেজিপ্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকার মধ্যে। অন্যান্য মাছের মধ্যে রুই মাছ মানভেদে ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাষের কই কেজিপ্রতি ২৫০ থেকে ৩৫০ টাকা ও চাষের পাবদা মাছ ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
আমিষের ঘাটতি
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএ থেকে বাংলাদেশের দানাদার খাদ্যবিষয়ক সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বেশি দামে আটা কিনতে না পারায় দেশের মানুষের বড় অংশ রুটি, বিস্কুট ও আটা-ময়দা থেকে তৈরি খাদ্য কম খাচ্ছে। দাম বেশি থাকায় আটার তৈরি খাবারের বদলে মানুষ ভাত খাওয়া বাড়িয়ে দিয়েছে। গত এক বছরে ভাতের পরে দেশের দ্বিতীয় প্রধান ওই খাদ্য খাওয়ার পরিমাণ ১৫ লাখ টন কমছে।
গত বছরের অক্টোবরে প্রকাশিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) আরেক প্রতিবেদন বলছে, খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে ৬৮ শতাংশ মানুষ। নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। যেমন সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এ খাবারগুলো তাঁদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্রেস্ট ফিডিং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন ও পুষ্টিবিদ এস কে রায় প্রথম আলোকে বলেন, মানুষ বাজারে কাটছাঁট করছে। তাতে স্বাভাবিকভাবে প্রাণিজ আমিষ কম খেতে পারবে। এ সময়ে তুলনামূলক কম দামে পাওয়া যায়, এমন বিকল্প উৎস যেমন সয়াবিন, শিমের বীজ, আটা-ময়দা, ছোলা বা ডালজাতীয় খাবার থেকে প্রোটিন নিতে হবে। এসব খাবার বেশি খেতে হবে।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, নওগাঁ ও কুষ্টিয়া]