ব্যাংক ও রাজস্ব খাতে সংস্কার চান ব্যবসায়ীরা

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে মতবিনিময় শেষে ফটোসেশনে অংশ নেন আইসিসি বাংলাদেশের নেতারা। আজ বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়েছবি: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি শিল্পকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও চাঁদাবাজি বন্ধের দাবি জানিয়েছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা ব্যাংক খাত ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার চেয়েছেন।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে আজ মঙ্গলবার বিকেলে প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী মতবিনিময়কালে এ দাবি করেন ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স (আইসিসি) বাংলাদেশের নেতারা। সভার শুরুতে তাঁরা কয়েকটি সংবাদপত্রে ছাপা হওয়া ব্যাংক লুটপাটের খবর দেখিয়ে বলেন, এক-দুজন ব্যবসায়ীর কাছে যদি এত টাকা চলে যায়, তাহলে অন্য ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে কীভাবে টাকা পাবেন।

ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ সভায় আইসিসি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান; আইসিসি বাংলাদেশের সহসভাপতি এ কে আজাদ ও নাসের এজাজ বিজয়, সদস্য তপন চৌধুরী, কুতুবউদ্দিন আহমেদ, মীর নাসির, মাহবুবুল আলম, আফতাব উল ইসলাম, কামরান টি রহমান, সিমিন রহমান, ফজলুল হক, মোহাম্মদ হাতেম, আশরাফ আহমেদ প্রমুখ।

এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আইসিসি বাংলাদেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, তাঁর প্রশাসন উত্তরাধিকারসূত্রে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পেয়েছে। তবে তিনি নিশ্চিত যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা এখন খুব কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছি। তবে এটাকে বড় সুযোগ হিসেবে আমরা নিতে পারি। আমাদের কাজ কঠিন, তবে অনেক বেশি সম্ভব।’ তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ যদি একটি জাতি হিসেবে সম্মিলিতভাবে এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমরা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করব।’

আইসিসি বাংলাদেশের নেতারা অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে তাড়াহুড়ো না করে প্রয়োজনীয় সংস্কারের আহ্বান জানান। তাঁরা বলেন, বিদায়ী সরকার দেশকে ধ্বংসের মুখে ফেলে দিয়েছে। ব্যাংক খাত, রাজস্ব প্রশাসন, শিক্ষা ও শিল্পে সংস্কার ও পুনর্গঠন প্রয়োজন।

আইসিসি বাংলাদেশের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে যা যা ঘটেছে, আমরা তার সাক্ষী। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত শতভাগ আপনার (প্রধান উপদেষ্টা) সঙ্গে আছে।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূস ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলকে বলেন, ‘জাতি হিসেবে মহানুভবতা অর্জনের জন্য বাক্সের বাইরে চিন্তা করতে হবে। যদি আমরা তরুণদের স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে পারি, তাহলে আমরা জাতির স্বপ্নকে সত্যি করতে পারব।’

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অনুষ্ঠাত সভায় উপস্থিত ছিলেন এমন তিনজন ব্যবসায়ী নেতার সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়। তাঁরা জানান, আইসিসি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি; ব্যাংক, এনবিআর ও জ্বালানি খাতের সংস্কার; তথ্যপ্রযুক্তি খাত শক্তিশালীকরণ; বিদেশি মিশনের সক্ষমতা বৃদ্ধি; তথ্য-উপাত্তে স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্য সংগঠনের সংস্কারসহ ১৩ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন নেতারা।

শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বাজার, মহাসড়ক, ফুটপাতসহ সব এলাকায় চাঁদাবাজি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আইসিসি বাংলাদেশের নেতারা বলেন, একটা সরকার গেছে। কোথাও কোথাও দেখা যাচ্ছে, নতুন গ্রুপ চাঁদাবাজি শুরু করে দিয়েছে। শিল্পকারখানা ও অর্থনৈতিক অঞ্চলে যৌথ বাহিনীর মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের দাবি জানান তাঁরা।

ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে একটি রূপকল্প তৈরি করুন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। একই সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে কার্যকর উদ্যোগ লাগবে।

প্রকৃত ঋণখেলাপি ও ব্যাংক লুটপাটকারীদের একই কাতারে না ফেলতে প্রধান উপদেষ্টাকে অনুরোধ করেন ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁরা বলেন, উভয় পক্ষকে একই কাতারে ফেললে ব্যাংক লুটকারীদের শাস্তি কম হবে। অন্যদিকে প্রকৃত ঋণখেলাপির শাস্তি বেশি হবে।

এ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ব্যাংক লুট ও পাচারকারীদের সম্পর্কে আপনারা লিখিত আকারে তথ্য দেন। আমরা সেটি ধরে কাজ করব।’ এ সময় আইসিসি বাংলাদেশের একজন সদস্য তথ্য দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

এনবিআরের সংস্কার চেয়ে ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, নীতি প্রণয়ন এবং কর, শুল্ক ও ভ্যাট আদায়ের জন্য সংস্থাটিতে দুটি পৃথক শাখা থাকতে পারে। পুরো এনবিআরকে ডিজিটালাইজেশন করতে হবে। এ ছাড়া রপ্তানি ও আমদানিকারকেরা যাতে এনবিআর কর্মকর্তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার না হন, সে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ব্যবসায়ী নেতারা বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ রপ্তানি খাতের ব্র্যান্ডিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার সহযোগিতা চান তাঁরা। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা বড় বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানোর উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেন।

আইসিসি বাংলাদেশের একজন সদস্য বলেন, ‘গত ১৫ বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা ছিল না। ৫ আগস্টের পর আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও বাক্স্বাধীনতা অনুভব করতে পারছি।’ এটি যেন বজায় থাকে সেই অনুরোধ জানান তিনি।