কিথ রুপার্ট মারডক। দুনিয়াজুড়ে মিডিয়া মোগল হিসেবে পরিচিত। মিডিয়ার ব্যবসা করে যে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় অতিধনীদের কাতারে স্থান পাওয়া যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন। ১ হাজার ৮৪০ কোটি মার্কিন ডলারের ধনসম্পদ নিয়ে নবতিপর মারডক ২০২২ সালের বৈশ্বিক অতিধনীর তালিকায় ৭৬তম স্থান পেয়েছেন। কে হবেন তাঁর সুবিশাল মিডিয়া সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী?
পিতা মারা যাওয়ায় মাত্র ২১ বছর বয়সেই কিথ রুপার্ট মারডকের কাঁধে এসে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার ছোট্ট একটি পারিবারিক সংবাদপত্র সংস্থা ‘নিউজ করপোরেশন’–এর দায়িত্ব। পরবর্তী বিগত ৭০ বছরে তিনি সেটাকেই তর্ক সাপেক্ষে ইতিহাসের সবচেয়ে শক্তিশালী ও রক্ষণশীল মিডিয়া সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। ১৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩৫০ কোটি মার্কিন ডলারের বাজার মূলধনবিশিষ্ট এই নিউজ করপোরেশন এখন পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী কোম্পানিগুলোর একটি। আর সংবাদমাধ্যমটির মালিক রুপার্ট মারডক অনেক আগেই বিশ্বব্যাপী ‘মিডিয়া মোগল’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।
ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক কূটকৌশল গ্রহণ এবং পারিবারিক লড়াই এড়িয়ে রুপার্ট মারডক এ মিডিয়া পাওয়ার হাউস গড়ে তুলেছেন। এ সাফল্যের সুবাদে তিনি এক অজেয় ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছেন। তাঁর নিজ হাতে গড়ে তোলা নিউজ করপোরেশন তথা মিডিয়া সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরি তথা নেতা কে হবেন, তা নিয়ে ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক ও বিনোদনজগতে এখন জল্পনাকল্পনা চলছে।
রুপার্ট মারডক ১৯৩১ সালের ১১ মার্চ অস্ট্রেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে রুপার্ট মারডকের পিতা কিথ মারডক মারা যান। তখন রুপার্ট তাঁর পিতার মালিকানাধীন অ্যাডিলেড শহরের ছোট্ট ‘নিউজ করপোরশন’ পরিচালনার দায়িত্ব পান। এরপর ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তিনি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বেশ কয়েকটি সংবাদপত্রের মালিকানা গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ সাল তিনি যুক্তরাজ্যে মিডিয়া সাম্রাজ্য বিস্তৃত করেন। ১৯৭৪ সালে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটি। ১৯৮৫ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব নেন।
মারডক তাঁর মূল কোম্পানি নিউজ করপোরেশনের মাধ্যমে শত শত স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের মালিকানা গ্রহণ করেন। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের দ্য সান ও দ্য টাইমস; অস্ট্রেলিয়ার দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, হেরাল্ড সান ও দ্য অস্ট্রেলিয়ান; মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ও নিউইয়র্ক পোস্ট ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি বই প্রকাশক হারপারকলিন্স, টেলিভিশন সম্প্রচার চ্যানেল স্কাই নিউজ অস্ট্রেলিয়া, ফক্স নিউজ স্কাই (২০২৮ সাল পর্যন্ত), টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স (২০১৯ পর্যন্ত) এবং অধুনালুপ্ত নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড–এর মালিক হন। রুপার্ট মারডক বিশ্বের শীর্ষ অতিধনীদেরও একজন। যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফোর্বস–এর চলতি ২০২২ সালের অতিধনী তালিকায় রুপার্ট মারডক ২ হাজার ৮০ কোটি মার্কিন ডলারের ধনসম্পদ নিয়ে বিশ্বে ৭৬তম স্থান পান। গতকাল রোববার অবশ্য তাঁর সম্পদের মূল্য কমে ১ হাজার ৮৪০ কোটি ডলারে নেমে আসে।
বর্তমানে মিডিয়া মোগল রুপার্ট মারডকের বয়স ৯১ বছর। তাঁর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারী ও বৃহত্তর মারডক গোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ নেতা কে হবেন, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তাঁর সম্ভাব্য উত্তরাধিকারীদের তালিকায় চার সাবেক স্ত্রী ও এই স্ত্রীদের ছয় সন্তান মিলিয়ে ১০ জনের নাম আলোচনায় রয়েছে।
১. লাচলান মারডক: একসময় পার্ট মারডক ও তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী আনা মারিয়ার (১৯৬৭–৯৯) বড় ছেলে লাচলান মারডককে উত্তরাধিকার মনে করা হতো। লাচলান অল্প বয়সেই তাঁর বাবার মিডিয়াগুলোতে ইন্টার্নশিপ করার মাধ্যমে পারিবারিক ব্যবসা শিখতে শুরু করেছিলেন। তিনি দ্রুত নির্বাহী পদে উন্নীত হন এবং ১৯৯৭ সাল নাগাদ নিউজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী হন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত লাচলানের পথ মসৃণ ছিল। এরপর তিনি পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়ে ইলিরিয়া নামে নিজস্ব একটি বিনিয়োগ কোম্পানি চালু করেন। অবশ্য ২০১৪ সালে তিনি আবার পারিবারিক ব্যবসায়ে ফিরে আসেন। লাচলান এখন ফক্স করপোরেশনের নির্বাহী চেয়ার ও সিইও; নিউজ করপোরেশনের সহ-চেয়ারম্যান।
২. জেমস মারডক: রুপার্ট মারডকের চতুর্থ ও আনা মারিয়ার দ্বিতীয় পুত্র। প্রথমে তিনি নিজেই ব্যবসা শুরু করেন। এরপর পারিবারিক ব্যবসায়ে জড়িত হন। নিউজ করপোরেশনে নির্বাহী ভূমিকা পালন করেন। ২০০৫ সালে বড় ভাই লাচলান ফক্স ছেড়ে দেওয়ার পর জেমসকেই পিতা রুপার্ট মারডকের উত্তরাধিকারী হিসেবে ভাবা হয়। তিনি ২০০৭ সালে বিস্কাইবির চেয়ারম্যান এবং ২০১১ সালে নিউজ করপোরেশনের ডেপুটি সিওও এবং নিউজ ইন্টারন্যাশনালের চেয়ারম্যান ও সিইও নিযুক্ত হন। এরই মধ্যে তাঁদের কোম্পানি কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে। তাঁদের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ফোন হ্যাক করার অভিযোগ ওঠে। ফলে জেমস বিস্কাইবির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন।
বেশ কয়েক বছর বিরতির পর তিনি আবার পারিবারিক ব্যবসায় যোগ দেন। এরপর তিনি স্কাইয়ের চেয়ারম্যান ও টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরি ফক্স–এর সিইও হন। ২০২০ সালে তিনি নিউজ করপোরেশনের বোর্ড থেকে পদত্যাগ করেন।
৩. এলিজাবেথ মারডক: তিনি রুপার্ট মারডক ও আনা মারিয়া দম্পতির প্রথম সন্তান। এলিজাবেথ মারডক ইন্টার্নশিপ ও এন্ট্রি লেভেল চাকরির মাধ্যমে পারিবারিক ব্যবসায়ে জড়িত হন। ১৯৯৬ সালে তিনি স্কাই নেটওয়ার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং এরপর স্কাই-এর প্রধান নির্বাহীর দায়িত্ব পান। তাঁকে পিতা রুপার্ট উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনায় রাখেননি। ২০০০ সালে এলিজাবেথ পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে যুক্তরাজ্যের অন্যতম প্রযোজনা সংস্থা শাইন–এ যোগ দেন। কিন্তু ২০১১ সালে রুপার্ট মারডক শাইন কিনে নেয়। এর সঙ্গে থাকতে পারেননি এলিজাবেথ। অবশেষে ২০১৯ সালে তিনি ‘সিস্টার’ নামে একটি প্রডাকশন কোম্পানি খোলেন।
৪. প্যাট্রিসিয়া বুকার: সাবেক ডিপার্টমেন্ট স্টোর মডেল ও ফ্লাইট অ্যাটেনডেন্ট প্যাট্রিসিয়া বুকার রুপার্ট মারডকের প্রথম স্ত্রী। তাঁরা ১৯৫৬ সালে বিয়ে করেন এবং ১৯৬৭ সালে তাঁদের বিচ্ছেদ হয়। রুপার্ট মারডক ও প্যাট্রিসিয়ার একজন মেয়ে আছে, যাঁর নাম প্রুডেন্স মারডক। রুপার্টের উত্তরাধিকারী হিসেবে প্যাট্রিসিয়ার নামও আলোচনায় আছে।
৫. আনা মারিয়া টর্ভ: দ্বিতীয় স্ত্রী আনা মারিয়াকেও রুপার্ট মারডকের মিডিয়া সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হওয়ার অন্যতম প্রতিযোগী মনে করা হয়। তাঁরা ১৯৬৭ সালে বিয়ে করেন এবং ১৯৯৯ সালে বিচ্ছেদ ঘটান। তাঁদের তিন সন্তান এলিজাবেথ, ল্যাচলান ও জেমসও প্রতিযোগিতায় রয়েছেন।
৬. ওয়েন্ডি ডেং: রুপার্ট মারডকের তৃতীয় স্ত্রী ওয়েন্ডি ডেং–এর নামও আছে উত্তরাধিকারীর তালিকায়। ওয়েন্ডি হংকংয়ে মারডকের স্টার টিভি নেটওয়ার্কে কাজ করতেন। ১৯৯৯ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। এতে মারডকের আগের সন্তানেরা নাখোশ ছিলেন। মারডক–ওয়েন্ডি দম্পতির দুটি সন্তান রয়েছে—গ্রেস মারডক ও ক্লো মারডক। একসময় রুপার্টের উপদেষ্টাও ছিলেন ওয়েন্ডি। যদিও ২০১৩ সালে মারডক–ওয়েন্ডির বিচ্ছেদ ঘটে।
৭. জেরি হল: সাবেক সুপারমডেল ও রক স্টার মিক জ্যাগারের প্রাক্তন বান্ধবী জেরি হলের সঙ্গে মারডকের বিয়ে হয় ২০১৬ সালে। জেরির বয়স বেশি হওয়ায় মারডকের আগের সন্তানেরা সহজভাবেই এ বিয়ে মেনে নিয়েছিলেন। ফলে মারডক পরিবারে সংহতির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হন জেরি হল। কিন্তু গাঁটছড়া বাঁধার ছয় বছরের মাথায় সম্প্রতি জেরির সঙ্গেও মারডকের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে। তবে মারডকের উত্তরাধিকারী হিসেবে জেরি হলের নামও আলোচনায় রয়েছে।
৮. প্রুডেন্স ম্যাক্লিওড রুপার্ট: রুপার্ট মারডকের সবচেয়ে বড সন্তান প্রুডেন্স ম্যাক্লিওড রুপার্ট। তিনি মারডকের প্রথম স্ত্রী প্যাট্রিসিয়ার মেয়ে। প্রুডেন্স কখনোই পারিবারিক ব্যবসা পরিচালনায় খুব বেশি আগ্রহ দেখাননি। অর্থাৎ তিনি উত্তরাধিকারী হওয়ার লড়াই থেকে নিজেকে দূরে রেখেছেন। তবে তিনি নিউজ করপোরেশনের বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন এবং বর্তমানে টাইমস নিউজপেপারসের বোর্ডে রয়েছেন।
৯-১০. গ্রেস মারডক ও ক্লো মারডক: গ্রেস মারডক ও ক্লো মারডক হলেন রুপার্ট মারডকের সবচেয়ে ছোট দুই সন্তান। তাঁদের মা ওয়েন্ডি ডেং ছিলেন মারডকের তৃতীয় স্ত্রী। তাঁরাও অতিধনী রুপার্ট মারডকের উত্তরাধিকারী হওয়ার দৌড়ে রয়েছেন। সূত্র: সিএনএন।