নানা ছুতায় বাড়ে সবজির দাম
যশোরের বারীনগর থেকে দিনে ২৫ ট্রাক সবজি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়। আগে ৪০ ট্রাক সবজি পাঠানো হতো।
বগুড়া থেকে ১৪ টন সবজি পরিবহনে আগে খরচ ছিল ১২ হাজার, এখন ১৬ হাজার টাকা।
ঢাকায় গত দুদিনে সবজির দাম কিছুটা কমেছে।
সবজির বাজারে এখন আগুন। জ্বালানি তেল ও ইউরিয়া সারের দাম যত বেড়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ বেড়েছে সবজির দাম। সবজির দামের এই ঊর্ধ্বগতির জন্য কৃষক ও পাইকারেরা খুচরা ব্যবসায়ীদের দুষছেন। তাঁদের অভিযোগ, কয়েক হাত ঘুরে সবজি বেচাকেনার কারণে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে দামের অস্বাভাবিক তারতম্য ঘটে। নানা ছুতায় বাড়ানো হয় সবজির দাম। এ কারণে ভোগান্তিতে পড়েন ভোক্তারা, দাম কম পান উৎপাদকেরা, কিন্তু লাভবান হন মূলত মধ্যস্বত্বভোগীরা।
সবজিভান্ডারখ্যাত যশোর ও বগুড়া থেকে ঢাকার বাজারে সবজির সরবরাহও কমে গেছে। সবজি বেচে লাভ কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় সবজি পাঠাতে চাইছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, অনাবৃষ্টিতে সবজির চাষ কম হওয়ায় এবং ফলন বিপর্যয়ে বাজারে সরবরাহের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। যে কারণে দামও বেড়েছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার বগুড়া এবং যশোরের বড় দুটি পাইকারি সবজির বাজার ঘুরে কৃষক, ব্যবসায়ী ও পাইকারদের সঙ্গে কথা বলে প্রথম আলোর এই দুই প্রতিবেদক এমন চিত্র পেয়েছেন।
হাতবদল কম হলে সবজির দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকবে উল্লেখ করে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবজির উৎপাদনকেন্দ্র থেকে বিক্রয়কেন্দ্রের দূরত্ব কমাতে হবে। তাহলে বাড়তি পরিবহন ব্যয় ক্রেতার ওপরে পড়বে না। এ জন্য সমবায় সমিতির মাধ্যমে উৎপাদন পর্যায় থেকে সবজি সরাসরি বাজারজাত করা গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমবে, কৃষক দাম পাবেন। রাজধানীর আশপাশের এলাকায় সবজি আবাদের বলয় গড়ে তোলা গেলে বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়বে।’
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে-পরে
যশোরের বারীনগর থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার ২৫ ট্রাক সবজি ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠানো হয়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে ৩৮ থেকে ৪০ ট্রাক সবজি পাঠানো হতো। সে হিসাবে প্রতি হাটে অন্তত ১৫ ট্রাক করে সবজি পাঠানো কমেছে।
হাটের ইজারাদার ও সবজির ব্যাপারীরা বলছেন, পাঁচ টনের এক ট্রাক সবজি যশোর থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে নিতে ট্রাকভাড়া ২০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। ডিজেলের দাম বাড়ার আগে যার ভাড়া ছিল ১৬ হাজার টাকা। সবজি প্যাকেজিং, গ্রেডিং করে ট্রাকে ওঠানো-নামানোর জন্য যে শ্রমিকের দৈনিক মুজরি ছিল ৩০০ টাকা, তাঁদের এখন দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা। প্রতি কেজিতে এক থেকে দুই টাকা খরচ বেড়েছে। যে কারণে ঢাকায় নিয়ে সবজি বিক্রি করে লাভ থাকছে সীমিত।
পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বেশি হওয়ায় যশোরের সবজি ঢাকায় নিয়ে প্রতিযোগিতায় টেকা যাচ্ছে না। সে তুলনায় ঢাকার আশপাশের কেরানীগঞ্জ, মানিকগঞ্জের সবজির পরিবহন খরচ অনেকটা কম। এ কারণে যশোরের মোকামে বাইরের ব্যাপারীদের আসা অনেকটা কমে গেছে।
যশোর ও বগুড়া থেকে ঢাকায় সবজির সরবরাহ কমে গেছে। সবজি বেচে লাভ কমে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী ঢাকায় সবজি পাঠাতে চাইছেন না।
বারীনগর হাটের ইজারাদার আবদুস সোবহান বলেন, পরিবহন খরচসহ অন্যান্য খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাইরের ব্যাপারীরা এই মোকামে আসা অনেকটা কমিয়ে দিয়েছেন। ফলে এ বছর কোটি টাকা দিয়ে কেনা এই হাটে লোকসান হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জ্বালানি তেলসহ কৃষি উপকরণের দাম না কমালে সবজির উৎপাদন ও পরিবহনে আরও মারাত্মক প্রভাব পড়বে।
এদিকে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর বগুড়ায় সবজি উৎপাদনে খরচ বেড়েছে। এতে চাষিরা আর কম দামে সবজি বিক্রি করছেন না। বগুড়া সদরের তেলিহারা গ্রামের কৃষক আইজউদ্দিন বলেন, ইউরিয়া সারের দাম প্রতি কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়েছে সরকার। নতুন দর অনুযায়ী, ৫০ কেজির এক বস্তা ইউরিয়ার দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ১০০ টাকা। কিন্তু প্রতি বস্তায় ২০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে সার কিনতে হচ্ছে। বেশি দামে কিনতে হচ্ছে অন্যান্য সারও। এতে চাষাবাদে খরচ বেড়েছে।
বগুড়া সদরের ধাওয়াকোলার সবজিচাষি উজ্জ্বল হোসেন বলেন, সবজি চাষাবাদ অনেকটা সেচনির্ভর। ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৬ টাকা বৃদ্ধির কারণে সেচ খরচ বেড়েছে। উৎপাদন খরচও গুনতে হচ্ছে বেশি। এ ছাড়া খেত থেকে সবজি তুলে হাটে নেওয়ার জন্য পরিবহন খরচ দেড় গুণ বেড়েছে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে খেত থেকে মহাস্থান হাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার পথে সবজি পরিবহনে ভটভটিভাড়া ছিল প্রতি মণ ২০ টাকা। এখন ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতি মণে ৩৫ টাকা গুনতে হচ্ছে।
এই সবজিচাষি আরও বলেন, ‘গত বছর এই হাটে মুলা বিক্রি করেছি ২০০ টাকা মণ দরে। এবার ফলন বিপর্যয় ও খরচ বেড়ে যাওয়ায় ৮০০ টাকা মণ দরে সবজি বিক্রি করেও খুব বেশি লাভ হচ্ছে না।’
ট্রাকের ভাড়া কত বাড়ল
যশোরের বারীনগরের ব্যবসায়ী আতিয়ার রহমান পাইকারি মোকাম থেকে সবজি কিনে ট্রাকে করে ঢাকার কারওয়ান বাজার ও শ্যামবাজারে পাঠান। তিনি বলেন, এক কেজি সবজি ঢাকায় পাঠাতে বর্তমানে সাত থেকে আট টাকা খরচ পড়ে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সবজির দাম কেজিতে এক থেকে দুই টাকা বেড়েছে। পাইকারি হাট থেকেই গতকাল ৫৬ টাকা কেজি দরে বেগুন কিনেছেন তিনি। খরচসহ ঢাকায় কত টাকা কেজি দরে ওই বেগুন পাইকারিতে বিক্রি করবেন, তা নিয়ে সংশয়ে আছেন। পাঁচ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকে ১২ টনের মতো সবজি ঢাকায় নিতে এখন ট্রাকভাড়াই দিতে হচ্ছে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার আগে যা ছিল ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা।
ব্যাপারী মজনু রহমান বলেন, ‘এখন দুই টনের বেশি সবজি ঢাকায় পাঠানো যাচ্ছে না। ২০ দিন আগেও চার টন পাঠিয়েছি। পাইকারি বাজারেই সবজির সরবরাহ কম।’
কথা হয় বগুড়ার ট্রাকমালিক আইফল মিয়ার সঙ্গে। মহাস্থান হাট থেকে নিয়মিত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে সবজি পাঠান। হতাশ কণ্ঠে এই ব্যবসায়ী বলেন, বগুড়া থেকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শ্যামবাজার বা মিরপুর কাঁচাবাজার পর্যন্ত গড়ে ১৪ টন সবজি পরিবহনে আগে ট্রাকভাড়া ছিল ১২ হাজার টাকা। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর খরচ বেড়েছে ৪ হাজার টাকা।
মহাস্থান হাটের পাইকারি ব্যবসায়ী শাহাদৎ হোসেন বলেন, ১৪ টন সবজি পরিবহনে চট্টগ্রাম ও সিলেটের ভাড়া আগে ছিল যথাক্রমে ২০ ও ১৬ হাজার টাকা। এখন ভাড়া গুনতে হচ্ছে যথাক্রমে ২৪ ও ২০ হাজার টাকা। প্রতিটি পথের ভাড়াই বেড়েছে গড়ে ২৫ শতাংশ। পরিবহন খরচ ছাড়াও আছে হাটের টোল খরচ, বস্তাজাত করার শ্রমিক খরচ, কুলি খরচ। খরচ বেড়ে যাওয়ায় সবজির দামেও প্রভাব পড়েছে।
তবে পরিবহন খরচ বাড়ায় সবজির দাম বেড়েছে—এ কথা মানতে নারাজ মহাস্থান হাটের ইজারাদারের লোক শাহ আলম। তিনি বলছেন, ১৪ টন বা ১৪ হাজার কেজি সবজি পরিবহনে গড়ে তিন-চার হাজার টাকা ট্রাকভাড়া বেড়েছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে পরিবহন খরচ বেড়েছে ৫০ পয়সার কম। কিন্তু পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে সবজির দামে ব্যবধান অনেক বেশি। সবজির বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে বাজার তদারকি জোরদার করতে হবে।
হাতবদলেই দাম বাড়ে কয়েক গুণ
বগুড়ার মহাস্থান হাটে গত বুধবার ভালো মানের এক কেজি পেঁপে বিক্রি করে গাবতলীর নাড়ুয়ামালা গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান পেয়েছেন ৮ টাকা ৭৫ পয়সা। পাইকারি হাট থেকে ১০০ গজের মধ্যেই মহাস্থান খুচরা বাজার। হাতবদলের পর সেখানে এক কেজি পেঁপে কিনতে ধাওয়াকোলা গ্রামের আবদুর রশিদকে গুনতে হয়েছে ৩০ টাকা। আর ১২ কিলোমিটার দূরে বগুড়া শহরের ফতেহ আলী বাজার এবং কলোনি বাজারে গতকাল সকালে ক্রেতাদের ভালো মানের এই পেঁপে কিনতে হয়েছে ৩৫ টাকা কেজি দরে। এভাবে পাইকারি বাজারে কৃষক যে সবজি সস্তায় বিক্রি করেন, শুধু হাতবদলেই খুচরা বাজারে তার দাম চার গুণ পর্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে।
হাতবদলে পাইকারি ও খুচরা বাজারের দামের এই ফাঁরাক প্রায় সব সবজিতেই। খুচরা ব্যবসায়ীদের খোঁড়া যুক্তি, বেশি দরে সবজি কিনেছেন, তাই বেশি দরে বিক্রি করছেন।
বুধবার মহাস্থান হাটের ৩২ টাকা কেজির দেশি বেগুন মহাস্থান খুচরা বাজারে ৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মহাস্থান হাটের ১২০ টাকা কেজি দরের দেশি কাঁচা মরিচ ওই হাটের খুচরা বাজারে কিনতে হয়েছে ১৬০ টাকা দরে। আর ফতেহ আলী ও কলোনি বাজারে খুচরা পর্যায়ে ১৮০ টাকা কেজি দরে কিনতে হয় ক্রেতাদের। এক কেজি করলা মহাস্থান হাটে বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন ৪০ টাকা। এক হাত বদলের পর সেই করলা মহাস্থান খুচরা বাজারে ৬০ এবং ফতেহ আলী বাজারের খুচরা ক্রেতাদের কিনতে হয়েছে ৮০ টাকা কেজি দরে। মহাস্থানহাটে এক কেজি কচুমুখি বিক্রি করে কৃষক পেয়েছেন ২২ টাকা। খুচরা ক্রেতাদের সেই কচুমুখি কিনতে হয়েছে ৫০ টাকা কেজি।
ফতেহ আলী বাজারে কাঁচা মরিচ কিনতে আসা সজীব আহমেদ বলেন, ভারত থেকে আমদানি করা মরিচ আসছে। অথচ দামের ঝাঁজ কমেনি। এখনো ১৮০ টাকা কেজি দরেই মরিচ কিনতে হচ্ছে।
মহাস্থান হাট সবজি, কাঁচা ও পাকামাল ব্যবসায়ী ও আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কৃষকের কাছ থেকে কেনা সবজি সামান্য লাভ রেখে পাইকারি মোকামে পাঠানো হয়। অথচ খুচরা ব্যবসায়ীরা কয়েক গুণ বেশি লাভে সেই সবজি বিক্রি করেন।
যশোরের বারীনগর সবজির মোকামে হাটের দিন পটোল ও মুলা ২৩-২৪ টাকা, বেগুন ৫০-৫৬, কাঁকরোল ২৮-৩০, বরবটি ৪০, শিম ১৫০ টাকা কেজি এবং লাউ প্রতিটি ৩০-৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বারীনগর থেকে সাত মাইল দূরে যশোর শহরের প্রধান খুচরা কাঁচাবাজার হচ্ছে বড় বাজার। গতকাল দুপুরে বড় বাজার ঘুরে সবজির দামে বেশ পার্থক্য দেখা গেল। বড় বাজারে প্রতি কেজি মুলা ২৮-৩০ টাকা, বেগুন ৭০, কাঁকরোল ৪০, বরবটি ৫০ টাকা ও প্রতিটি লাউ ৪০-৫০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।
জানতে চাইলে বড় বাজারের খুচরা সবজি বিক্রেতা নাসির উদ্দীন বলেন, পাইকারি দামের সঙ্গে খুচরা বাজারের পার্থক্য তো থাকবেই। পরিবহন খরচ, আড়তদারিতেই তো কেজিতে তিন থেকে চার টাকা খরচ পড়ে যায়। এরপরে কাঁচা পণ্য ১০ শতাংশ নষ্ট হিসাবে ধরতে হয়। এ ছাড়া সরবরাহ ভালো থাকলে দাম কমে। কিন্তু এখন বাজারে সবজির সরবরাহই তো কম হচ্ছে।
নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা জানান, গতকাল ঢাকার মালিবাগ, মগবাজার ও কাঁঠালবাগান—এই তিনটি খুচরা বাজার ঘুরে একমাত্র কাঁচা মরিচ বাদে বাকি সব সবজি ৩০ থেকে ৭০ টাকার মধ্যে বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে গত দুই দিনে সবজির দাম তুলনামূলক কমেছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। ঢাকার বাজারে প্রতি কেজি বেগুন ৬০-৭০ টাকা, কাঁচা মরিচ ২০০-২৪০, পটোল ৪০-৫০, ঢ্যাঁড়স ৪০-৫০, মুলা ৪০-৫০, কচুমুখি ৪৫-৫০, কাঁকরোল ৪০-৫০, মিষ্টিকুমড়া ২৫-৩০, শসা ৬০-৭০, করলা ৫০-৬০, পেঁপে ৩০-৩৫, দেশি পাকড়ি (লাল) আলু ৩৫-৪০, জালি কুমড়া প্রতিটি ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা যায়।