মৌসুমে শীতের পোশাকের হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য
শীতের পোশাকের মৌসুমি ব্যবসা তিন মাসের। এর শুরুটা হয় নভেম্বরে, চলে জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত। তবে শীতের ওঠানামায় বেচাকেনা কমবেশি হয়ে থাকে। এই সময়ে রাজধানী ও আশপাশের জেলাগুলোয় তৈরি করা কম্বল, জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার, শাল ও চাদর ধাপে ধাপে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়। ঢাকাতেও বড় একটা বাজার রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে আলাপকালে ব্যবসায়ীরা জানান, সব মিলিয়ে শীতের পোশাকের শীতকেন্দ্রিক মৌসুমি বাণিজ্যের আকার হাজার কোটি টাকার ওপরে। এই ব্যবসার বড় অংশই রাজধানীর বঙ্গবাজার ও গুলিস্তানকেন্দ্রিক। এই দুই বাজারে কম্বলসহ অন্যান্য শীতের পোশাক বেচাকেনা হয় ৩০০ কোটি টাকার মতো।
নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডসহ আশপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে আরও দেড় শ কোটি টাকার বাজার। কেরানীগঞ্জ পোশাকপল্লি ও কামরাঙ্গীরচরে তৈরি হয় স্বল্প দামের শীতের পোশাক। তুলনামূলক কম দামি হলেও এসব পোশাকের বাজার এখন কয়েক শ কোটি টাকার। এর বাইরে মিরপুর, গাজীপুর ও সাভারে শীতের পোশাকের বাজার আছে। এসব জায়গায় পোশাক কারখানাগুলো থেকে কয়েক শ কোটি টাকার শীতের পোশাক আসে।
মৌসুমি এই ব্যবসায় এখন বড় ব্র্যান্ডগুলোও বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। সব মিলিয়ে শীতকেন্দ্রিক শীতের পোশাকের বাজারের আকার ন্যূনতম হাজার কোটি টাকা হবে বলে ব্যবসায়ীরা দাবি করেন। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, বাজারের আকারের চেয়ে এই ব্যবসায়ে বিনিয়োগ আরও বেশি। কারণ, স্বল্প সময়ের মধ্যে ব্যবসা করতে হলে লগ্নি বেশি করতে হয়। ব্যবসা ভালো না হলে পণ্য আটকে থাকে। পরের মৌসুমের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের মধ্যে তো বটেই, দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্যও শীতের পোশাক কিনতে চাইলে নির্ভরযোগ্য ঠিকানা বঙ্গবাজার। এটাই দেশের একমাত্র বাজার, যেখানে সারা বছর শীতের পোশাক পাওয়া যায়।
শীতের গরম পোশাকের পাশাপাশি কম্বলের চাহিদাও ভালো থাকে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, শৌখিন কম্বলের পুরোটা আমদানিনির্ভর। ত্রাণের কম্বল তৈরি হয় দেশে। সাধারণত বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি দাতা সংস্থা (এনজিও), সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো ত্রাণের কম্বলের বড় ক্রেতা। সরকারিভাবেও বিতরণের জন্য কম্বল কেনা হয়। পাইকারি কম্বল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠান এবার ৩০ লাখ কম্বল কিনছে বলে জানা গেছে।
বৃহত্তর কম্বল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী মো. আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, কম্বল তৈরির উপকরণ আমদানি ব্যয় বাড়ায় কম্বলের দাম গত বছরের তুলনায় বেড়েছে। কম্বলের বড় অংশ বিদেশ থেকে আসে। এরপরও এ বছর হরতাল, অবরোধসহ রাজনৈতিক সংকট না থাকলে ব্যবসা আরও ভালো হতো।
রাজধানীর বঙ্গবাজার-গুলিস্তানে হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান শীতের পোশাক বিক্রি করে। কেরানীগঞ্জ পোশাকপল্লিতে রয়েছে ১০ হাজারের বেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কামরাঙ্গীরচরের তৈরি পোশাকের দোকানগুলোর মধ্যে সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠান শীতের পোশাকের মৌসুমি ব্যবসা করে। নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকার মিতালি মার্কেট এলাকার ১৪টি ভবনে প্রায় দেড় হাজার দোকান ও ছোট পোশাক কারখানা আছে। একই এলাকার পারিজাত কম্বলের বাজারে পাইকারি ব্যবসায়ী আছেন দুই শতাধিক। রয়েছে কম্বল তৈরির বেশ কিছু কারখানাও। এর বাইরে বিভিন্ন বিপণিবিতানে ব্র্যান্ডের দোকান তো আছেই।
পোশাকের ব্র্যান্ড সারা লাইফস্টাইলের মূল প্রতিষ্ঠান স্নোটেক্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম খালেদ প্রথম আলোকে, ‘আমাদের দেশে শীত মৌসুমের ব্যবসাটি খুবই অল্প সময়ের জন্য হয়ে থাকে। আমরা গড়ে দুই লাখ পিস শীতের পোশাক বিক্রি করতে পারি।’
শীতের পোশাকের দরদাম
শীতের কাপড়ের বাজার সাধারণত দুই ধরনের। একটি কম্বলের বাজার, অন্যটি পোশাকের। কম্বলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, এবার প্রতিটি দেশি কম্বলের দাম বেড়েছে ২০ থেকে ৫০ টাকা। আর আমদানি করা বিদেশি কম্বলের একেকটার দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। ঢাকায় একটি দেশি কম্বল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ৭৫০ টাকায়। আর বিদেশি কম্বলের দামই শুরু হয় ৮০০ টাকা থেকে। আমদানি করা এসব কম্বলের দাম মানভেদে আট হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
শীতের পোশাকের তালিকায় রয়েছে জ্যাকেট, সোয়েটার, মাফলার, শাল, চাদর—যা ডেনিম, নিট ও উলের কাপড় দিয়ে তৈরি হয়। নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা পোশাক তৈরির পাশাপাশি বাচ্চাদের জন্যও বাহারি সব শীতের পোশাক বাজারে দেখা যায়। ব্যবসায়ীদের দাবি, কাপড় ও মজুরি বাবদ খরচ বেড়ে যাওয়ায় এবার পণ্যের দামও কিছুটা বেড়েছে। নারী, পুরুষ ও বাচ্চাদের শীতের পোশাকের মান ও আকারভেদে দাম ২০০ থেকে ২ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, নারায়ণগঞ্জ]