দেশে ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিপুলসংখ্যক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। আরও প্রায় কোটি মানুষ দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। এর কারণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি; চাল, ডাল, তেল, চিনিসহ নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি।
বেসরকারি সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে এ প্রাক্কলন করেছে। আজ রোববার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি’ শিরোনামে সাংবাদিকদের এক কর্মশালায় এ হিসাব তুলে ধরা হয়।
সংস্থাটি ২০২২ সালের মে মাস থেকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, এ সময়ে নতুন করে ৭৮ লাখ ৬০ হাজার মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। এর মধ্যে ৩৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ দরিদ্র থেকে হতদরিদ্র হয়েছেন। আর দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন ৯৮ লাখ ২০ হাজার মানুষ।
র্যাপিডের চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি ও মজুরি বৃদ্ধির সরকারি হিসাব পর্যালোচনা করে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির এ প্রাক্কলন করা হয়েছে। আমাদের ধারণা, মোট দারিদ্র্যও বেড়ে গেছে। প্রকৃত চিত্র বোঝা যাবে যদি বিবিএস বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে একটি জরিপ করে।’
কর্মশালায় র্যাপিডের এম এ রাজ্জাক, নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আবু ইউসুফ ও গবেষণা পরিচালক দীন ইসলাম উপস্থাপনাটির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি অনলাইনে যুক্ত হয়ে বলেন, বর্তমান সরকার মূল্যস্ফীতির সঠিক হিসাব দিচ্ছে। সে কারণে মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাচ্ছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা শুরুর পর বিশ্বজুড়ে পণ্যমূল্য বাড়তে থাকে। বাংলাদেশে প্রভাবটি পড়ে দুই ভাবে। একটি হলো আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়া। দ্বিতীয়টি হলো বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে যাওয়া ও মার্কিন ডলারের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বৃদ্ধি। তখন ডলারের দাম ছিল ৮৬ টাকা, এখন ১২০ টাকার বেশি। অর্থনীতিবিদেরা এ জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, নির্বিচার টাকা ছাপানো ও অর্থ পাচারকে দায়ী করেছেন। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মূল্যস্ফীতির হিসাবে কারসাজির অভিযোগও ছিল।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে পতন থেমেছে। ডলারের দাম মোটামুটি স্থিতিশীল হয়েছে; কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিবিএসের হিসাবে, গত মাস নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশে।
র্যাপিড বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, মূল্যস্ফীতি ব্যাপকভাবে বাড়লেও মজুরি বেড়েছে তার কম হারে। ফলে মানুষ ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই ক্রয়ক্ষমতা কমেছে ৬ শতাংশের মতো।
চাল, ভোজ্যতেল, পেঁয়াজ, ডিম ইত্যাদি নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি কম কার্যকর, কিন্তু এর অর্থনৈতিক মূল্য অনেক বেশি দিতে হয় বলেও উল্লেখ করেছে র্যাপিড। সংস্থাটি মনে করে, ১০ থেকে ১২টি নিত্যপণ্যের দাম কমাতে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা যায়।
এম এ রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা জোরালোভাবে দরিদ্র মানুষের ৯টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির বরাদ্দ বাড়ানোর সুপারিশ করেছি। এর জন্য বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) মাত্র ৮ শতাংশের সমপরিমাণ ব্যয় প্রয়োজন হবে। কিন্তু দরিদ্র ও নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য এটা বড় সহায়তা হিসেবে গণ্য হবে।’
৯টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি হলো খাদ্য সহায়তা, খোলাবাজারে বিক্রি (ওএমএস), কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা), বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং (ভিজিএফ), ভালনারেবল ওমেন বেনিফিট (ভিডব্লিউবি), বিধবা ভাতা এবং নারী ও শিশুদের সুরক্ষা কর্মসূচি। এসব খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করতে ২১ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি ব্যয় হবে। শুধু এডিপি আড়াই শতাংশ কাটছাঁট করা হলে খাদ্য সহায়তার তিন খাতে বরাদ্দ দ্বিগুণ করা সম্ভব।
র্যাপিডের নির্বাহী পরিচালক আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, এখন মানুষ সংকটে আছে। এ সময়ে উন্নয়ন ব্যয় কমিয়ে হলেও সহায়তা দেওয়া দরকার।