স্টার্টআপে ৩৬০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ

স্টার্টআপে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সময় এখন। খাতটিতে এ পর্যন্ত ৩,৬৩৮ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ এসেছে। তবে অনেক চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

ইনফোগ্রাফিকস: প্রথম আলো

দেশের স্টার্টআপগুলো গত এক দশকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে চলতি বছরে। আর খাত ভিত্তিতে সর্বাধিক বিনিয়োগ হয়েছে ফিনটেক তথা ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজিতে (আর্থিক প্রযুক্তি)।

খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দেশে এখন স্টার্টআপের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু সরকার ব্যবসা-সহায়ক মানসিকতা প্রদর্শন ও বিনিয়োগ পদ্ধতি সহজ না করলে এবং মেধার জোগান না বাড়লে বেশি দূর এগোনো যাবে না। অর্থাৎ স্টার্টআপে ব্যাপক সম্ভাবনার বিপরীতে চ্যালেঞ্জও রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা লাইটক্যাসল পার্টনার্স দেশের স্টার্টআপ নিয়ে গত সেপ্টেম্বরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ‘বাংলাদেশ স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম: ফান্ডিং ল্যান্ডস্কেপ’ শীর্ষক এই প্রতিবেদনে দেশের স্টার্টআপ খাতের গত এক দশকের অগ্রগতি ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে।

লাইটক্যাসল পার্টনার্সের তথ্যানুযায়ী দেশি-বিদেশি মিলিয়ে ২০১০ থেকে চলতি ২০২১ সাল পর্যন্ত স্টার্টআপে বিনিয়োগ হয়েছে ৪২ কোটি ৩০ লাখ ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৩ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮৬ টাকা ধরে)। এর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগই হলো ৩০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০১৫ সালে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাওয়ার পর ২০১৬-১৭ সালে কমে। ২০১৮ সাল থেকে আবার বড় বিনিয়োগ আসছে। অবশ্য ২০২০ সালে খাতটিতে করোনার নেতিবাচক প্রভাবও পড়েছে।

দেশে স্টার্টআপে সর্বোচ্চ ১৩ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ এসেছে চলতি ২০২১ সালে, যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ১১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ কোটি ৬০ লাখ ডলারই এসেছে বিদেশ থেকে। দেশীয় বিনিয়োগ মাত্র ৪০ লাখ ডলার। বিনিয়োগ হয়েছে ৪৮টি স্টার্টআপে।

দেশীয় স্টার্টআপে ২০১৩ সাল থেকে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। এখন পর্যন্ত দেশের মোট ২০৬টি স্টার্টআপ বিদেশি বিনিয়োগ নেওয়ার বিষয়ে চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ১০৬টি স্টার্টআপ বিনিয়োগ পেয়েছে। ২০১৭ সালে দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল প্রায় কাছাকাছি। সেই বছর ৫৪ দশমিক ২ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগের বিপরীতে স্থানীয় বিনিয়োগ ছিল ৪৫ দশমিক ৮ শতাংশ। পরের বছর থেকে বিদেশি বিনিয়োগই বেশি হচ্ছে।

লাইটক্যাসল পার্টনার্স জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ এসেছে ফিনটেকে (ফিন্যান্সিয়াল টেকনোলজি তথা আর্থিক প্রযুক্তি)। এই খাতের স্টার্টআপগুলো মোট বিনিয়োগের ৫০ দশমিক ৬০ শতাংশ পেয়েছে। এ ছাড়া লজিস্টিকস ২০ দশমিক ৯২ শতাংশ, ই-কমার্স ও খুচরা বিক্রি ১০ দশমিক ২৬ শতাংশ, হেলথকেয়ার তথা স্বাস্থ্যসেবা ৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ, কনজিউমার সার্ভিসেস ৪ দশমিক ২২ শতাংশ, সফটওয়্যার ও টেকনোলজি ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ বিনিয়োগ পেয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের সহায়ক মনোভাবের ফলে তথ্যপ্রযুক্তিসহ স্টার্টআপ খাত এগোচ্ছে, ডিজিটাল জগতে প্রবেশ বাড়ছে, মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা ও ই-কমার্স জোরদার হচ্ছে। স্টার্টআপকে মাথায় রেখে দেশে বিভিন্ন কার্যক্রম হচ্ছে। সেই সুবাদে ইকোসিস্টেম গড়ে উঠছে। সরকার ‘স্টার্টআপ বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করেছে।

১৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান

বর্তমানে দেশে সক্রিয় স্টার্টআপ আছে ১ হাজার ২০০টি। এই খাতে মোট ১৫ লাখের বেশি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। প্রতিবছর দুই শতাধিক নতুন স্টার্টআপ আসছে। তবে স্টার্টআপগুলো মূলত ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট—এই তিন শহরকেন্দ্রিক হয়ে থাকে।

গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশের ৮১টি স্টার্টআপ মোট ২৭ কোটি ১৬ লাখ ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। এই বিনিয়োগের ৯২ শতাংশ বিদেশি ও বাকি ৮ শতাংশ দেশীয়।

স্টার্টআপগুলোর মধ্যে বিকাশ ৮ কোটি ১০ লাখ, পাঠাও ৩ কোটি ৬০ লাখ, শপআপ ২ কোটি ৮০ লাখ, শিওর ক্যাশ ২ কোটি ৬০ লাখ, সহজ ও চালডাল ১ কোটি ৯৫ লাখ ও পেপারফ্লাই ১ কোটি ৩০ লাখ ডলারের বিদেশি বিনিয়োগ পেয়েছে।

এদিকে লাইটক্যাসলের প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিকাশ, শপআপ, চালডালসহ বেশি কিছু প্রতিষ্ঠান বড় অঙ্কের নতুন বিনিয়োগ পেয়েছে বলে জানা গেছে। সহজ কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গত বছরের জুন পর্যন্ত তারা আড়াই কোটি ডলারের বিনিয়োগ পেয়েছে।

চ্যালেঞ্জ

স্টার্টআপে অগ্রগতি হলেও বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে। যেমন গ্লোবাল স্টার্টআপ র‍্যাঙ্কিংয়ে ১০০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩তম। তবে গত বছরের চেয়ে এবার পাঁচ ধাপ এগিয়েছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্স বা উদ্ভাবন সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১৬তম স্থানে রয়েছে।

করোনার প্রভাব

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের ধাক্কায় ২৪ শতাংশ স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। ৫৬ শতাংশ স্টার্টআপের আয় ৫০ শতাংশ কমেছে। তবে ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস, লজিস্টিকস তথা পরিবহন, মুদি ও মনিহারি পণ্য, এডটেক ও হেলথটেক সেবার চাহিদা এই সময়ে অনেক বেড়েছে।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বেটার স্টোরিজ লিমিটেডের চিফ স্টোরিটেলার মিনহাজ আনোয়ার প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশে স্টার্টআপের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে বটে, কিন্তু পরিণত পর্যায়ে যেতে পারছে না। এ জন্য মেধা প্রয়োজন। কিন্তু প্রযুক্তি খাতে প্রয়োজনের চেয়ে কম মেধা আছে দেশে। এর ওপর দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে বের হয়ে মেধাবীরা বিদেশে চলে যাচ্ছে।

মিনহাজ আনোয়ার আরও বলেন, স্টার্টআপে যে বিনিয়োগ এসেছে, তার ৯৪ থেকে ৯৭ শতাংশ বাইরের। এ দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এখনো বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তাই বিনিয়োগ পদ্ধতি আরও সহজ করতে হবে।

মিনহাজ আনোয়ার আরও বলেন, সরকারের অনেক উদ্দেশ্য আছে কিন্তু বাস্তবায়নের মানসিকতায় আরও এগোতে হবে। সঠিকভাবে স্টার্টআপ বুঝতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও সহায়ক হতে হবে।