সরকারের ফুলটস বল আর পরিবহনমালিকদের ছক্কা
১৯৭৫ সালের ১৭ মে বাংলাদেশ ইতিহাসে প্রথমবারের মতো টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। ওই দিন এক ধাক্কায় টাকার অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল প্রায় ৫৮ শতাংশ। আইএমএফের পরামর্শে মুদ্রার এত বড় অবমূল্যায়ন করা হয়েছিল। এর পর থেকে বাংলাদেশ অসংখ্যবার টাকার অবমূল্যায়ন করলেও, তা অল্প অল্প মাত্রায়। একবারে ৫৮ শতাংশের মতো অবমূল্যায়নের পথে আর কখনো যায়নি বাংলাদেশ।
১৯৯০-এর দশকে শেষ দিক থেকে শুরু করে ২০০০ দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক অসংখ্যবার মুদ্রার অবমূল্যায়ন করেছে। তবে প্রতিবারই সামান্য করে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। বেশির ভাগ সময়েই ৫০ পয়সা করে অবমূল্যায়ন করা হতো। আমরা জানি, অবমূল্যায়ন করলে রপ্তানিকারকেরা লাভবান হন, আমদানি খানিকটা ব্যয়বহুল হয়। ফলে অতিমাত্রায় এবং একবারে বেশি হারে অবমূল্যায়ন করা হলে দেশের মধ্যে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে। কেননা, বেশির ভাগ পণ্যই আমদানি করা হয়। সুতরাং, দেশের মধ্যে ভোক্তা বা সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে প্রতিবারই সহনীয় মাত্রায় অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।
সরকার নির্ধারিত কোনো কিছুর দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে দুটি কথা সব সময়েই ব্যবহার করা হয়। যেমন, ‘সহনীয় মাত্রা’ ও ‘সমন্বয়’। অর্থাৎ, সরকার দাম বাড়ায় বা কমায় না, তারা কেবল দর সমন্বয় করে, তা-ও সহনীয় মাত্রায়। আর বাড়ালে সরকারের ভাষ্য ছিল, ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার মুদ্রা অবমূল্যায়ন করা হয়েছে, যতবার জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ, পানি বা গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে, প্রতিবার একই কথা বলা হয়েছে। তবে ভোজ্যতেল বা চিনির দর নির্ধারণের ক্ষেত্রে সরকারের কৌশল একটু ভিন্ন। যখন বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যায়, তখন সামান্য লাভ বা কিছুটা লোকসান হয়, এমন একটা দর সরকার নির্ধারণ করে দেয়। ব্যবসায়ীরা খুব একটা উচ্চবাচ্য করেন না। কারণ, যখন বিশ্ববাজারে দাম কমে যায়, তখন সরকার আগের লোকসান পুষিয়ে দিতে উচ্চ দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে ব্যবসায়ীরা আগের লোকসান কাটিয়ে ঠিকই বড় অঙ্কের লাভ করেন। এই নীতি চলে আসছে বছরের পর বছর ধরে।
তাহলে হঠাৎ করে সরকার কেন ডিজেল আর কেরোসিন তেলের দাম লিটার প্রতি ১৫ টাকা বাড়িয়ে দিল? জ্বালানি তেলের দর লিটারে ১৫ টাকা বাড়ানোর ইতিহাস আর নেই। আমরা জানি, গত সাত বছরে সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করেছে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম শূন্যে নেমে এলেও বিপিসির আগের লোকসান কাটাতে সরকার জ্বালানি তেলের দাম কমায়নি। কেবল চক্ষুলজ্জার জন্য ২০১৬ সালে সামান্য হারে দর কমানো হয়েছিল। যেমন ডিজেল ও কেরোসিনে দাম কমেছিল মাত্র লিটারে ৩ টাকা আর অকটেন ও পেট্রলে ১০ টাকা।
আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন বাড়তে শুরু করেছে। তেল রপ্তানিকারক দেশগুলো আগের লোকসান কাটাতে তেল উত্তোলন কমিয়ে দিয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বব্যাপী আলোচনার মধ্যেই দেশের মধ্যে জ্বালানি মন্ত্রণালয় হুট করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) তেলের ব্যবসা নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন হয়ে একলাফে ১৫ টাকা করে বাড়িয়ে দিল। অর্থাৎ, ব্যবসায়ী বিপিসি যাতে একটা টাকাও আর লোকসান না দেয়। লাভজনক থাকতে হবে, এটাই বড় কথা, সরকারের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যতই লোকসানে থাকুক না কেন। তবে এবার কিন্তু সহনীয় পর্যায়ে মূল্যবৃদ্ধির কোনো আলোচনা শোনা গেল না। তবে কয়েকজন নীতিনির্ধারকের বেশ কিছু বাণী অবশ্য শোনা গেছে। যেমন, তাঁরা বলছেন যে এর ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণ নেই, প্রতিবেশী দেশে চোরাচালান হয়ে যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।
একলাফে ১৫ টাকার মূল্যবৃদ্ধি কি পরিবহন ভাড়া বাড়ানোর জন্য পাতানো খেলা? এই প্রশ্ন এ জন্য যে সরকারি ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সব ধরনের পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। ধর্মঘটে চলে গেছেন সব ধরনের পরিবহনমালিকেরা। তবে পরিবহন খাতের বড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান অবশ্য সাফাই গেয়ে বলেছেন, এটা ধর্মঘট নয়, লোকসান হবে বলে পরিবহন বন্ধ রাখা হয়েছে। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের না বোঝার কথা না যে একলাফে ১৫ টাকা বাড়ালে পরিবহন খাতে কী প্রতিক্রিয়া হবে। বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান বা লঞ্চমালিকেরা এই সুযোগ নিতে এক বিন্দু সময় নেননি। তা ছাড়া পরিবহনমালিকেরা অনেক দিন ধরেই ভাড়া বাড়ানোর পাঁয়তারা করছিলেন। সুতরাং, সরকারও সময়মতো সুযোগটা করে দিল। এ যেন অনেকটা ক্রিকেটের ফুলটস বলের মতো। জ্বালানি মন্ত্রণালয় ফুলটস একটি বল দিয়েছে আর পরিবহনমালিকেরা সপাটে ছক্কা পিটিয়েছেন। বেচারা দর্শকদের তো এখন মাঠের গ্যালারিতে বসার সুযোগও নেই। গ্যালারিতে দর্শক থাকল কি না, তাতে সরকারের কী যায় আসে?
পরিবহন মালিকেরা সফল। ভাড়া বাড়ছে সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ। এবার দেখা যাক এর প্রভাব আর কোথায় কোথায় পড়বে।