মুঠোফোন সেবা
রাজস্ব-মুনাফা বাড়ছে, মান কমছে
মুঠোফোন ইন্টারনেটের গতিতে ১৩৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৫তম।
কথা শোনা না যাওয়া ও কল ড্রপের বিস্তর অভিযোগ।
মুঠোফোন সেবার মান যে খারাপ, তা বলছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাই।
দেশে মুঠোফোন গ্রাহকের সংখ্যা প্রতি মাসেই বাড়ছে। বাড়ছে অপারেটরের মুনাফা। বাড়তি কর পাচ্ছে সরকারও। কিন্তু সেবার মানে অবনতি হচ্ছে বলে অভিযোগ গ্রাহকদের। তাঁরা বলছেন, মুঠোফোনে কল করতে গেলে অনেক সময়ই কথা শোনা যায় না। কল সংযোগেও সময় বেশি লাগছে। ইন্টারনেটের ধীরগতির সমস্যা তো রয়েছেই।
করোনার বছরেও শীর্ষ দুই অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবির মুনাফা বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে বিটিআরসির রাজস্ব বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। চলতি অর্থবছর থেকে সরকার প্রতি ১০০ টাকার কথা বলায় ৩ টাকা কর বাড়িয়ে ২৫ টাকা নিচ্ছে। অপারেটরগুলো বলছে, তাদের রাজস্ব আয়ের ৫৫ শতাংশের মতো সরকারের কোষাগারে যায় বিভিন্ন কর ও ফি হিসেবে।
বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) তথ্য অনুযায়ী, তিন বছরে দেশে মুঠোফোন গ্রাহক ২ কোটি ৩০ লাখ বেড়ে ১৭ কোটি ছাড়িয়েছে। আর ইন্টারনেট গ্রাহক ২ কোটি ৬৯ লাখ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ কোটির বেশি।
কিন্তু সেবার মান কেমন? ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত বুধবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্রাহকের ভোগান্তির কথা আমরা জানি। এ জন্য অনেক আগে থেকেই অপারেটরদের বাড়তি তরঙ্গ নেওয়ার জন্য বলে আসছি।’ তিনি বলেন, মুঠোফোন সেবার মানের ক্ষেত্রে যে সমস্যা রয়েছে, তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তরঙ্গ বরাদ্দ, বাড়তি টাওয়ার বসানো ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক কেব্ল নিয়ে যাওয়া—এগুলোর ফলে ভবিষ্যতে সেবার মান বাড়বে।
এর আগে গত ৭ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রথম আলোর প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসির নতুন চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর শিকদার সেবার মান যে ভালো নয়, তা স্বীকার করেন।
গ্রাহকের অভিযোগ
মুঠোফোন সেবার মান নিয়ে বিটিআরসি গত ২১ জানুয়ারি ৩০০টি উপজেলায় মুঠোফোন সেবার মান পরীক্ষার একটি কার্যক্রম শুরু করেছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতির কোনো পরিসংখ্যান আপাতত নেই। তবে গ্রাহকেরা তাঁদের বিরূপ অভিজ্ঞতার কথা বলছেন। কয়েকটি সাধারণ অভিজ্ঞতা—একটু দীর্ঘ সময় কথা বললে না শোনা, অস্পষ্ট শোনা, অন্য অপারেটরে কল সংযোগে বাড়তি সময় লাগা, কল ড্রপ ইত্যাদি। ইন্টারনেটের ধীরগতি, মুঠোফোনে বিভিন্ন অ্যাপ ব্যবহার করে কথা বলতে গেলে বারবার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া, শুনতে না পাওয়ার সমস্যাও রয়েছে। এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন জায়গায়, ভবনের নিচতলা, চলন্ত অবস্থায় এবং অন্যান্য আরও ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক না পাওয়ার সমস্যা পুরোনো। রাজধানীর শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এতটা খারাপ অবস্থা আগে কখনো ছিল না।’
মোবাইলে ইন্টারনেটের গতির পরিস্থিতির একটা পরিসংখ্যান পাওয়া যায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওকলার কাছে, যারা প্রতি মাসে বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষা করে তুলনামূলক চিত্র প্রকাশ করে। গত ডিসেম্বরে গতির দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল বিশ্বে ১৩৫তম। তারা মোট ১৩৯টি দেশের হিসাব রাখে।
ওকলার পরীক্ষা বলছে, গত বছর জানুয়ারি মাসে দেশে মুঠোফোন ইন্টারনেটের ডাউনলোড গতি ছিল ১১ এমবিপিএসের (মেগাবিট পার সেকেন্ড) বেশি। সেটা করোনার শুরুর দিকে মার্চ-এপ্রিল দুই মাসে বেশ কমে যায়। এখনো গতি গত বছরের জানুয়ারির তুলনায় কম।
গতিতে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে ভারত (১২৯তম), পাকিস্তান (১১৪), নেপাল (১১৫) মিয়ানমার (৮৫) ও ভিয়েতনাম (৬২)। সবচেয়ে ভালো অবস্থানে কাতার। সেখানে ডাউনলোডের গতি ১৭৮ এমবিপিএস, বাংলাদেশের ১৬ গুণ।
কথা শুনতে না পাওয়া, কল ড্রপ, ইন্টারনেটে ধীরগতিসহ নানা সমস্যায় গ্রাহকেরা। বিপরীতে সরকারের রাজস্ব ও অপারেটরের মুনাফা বাড়ছে।
টাওয়ার বসেনি, তরঙ্গও কম
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, করোনাকালে মুঠোফোন সেবার মান কমে যাওয়ার বড় কারণ, হঠাৎ করে গ্রাহক ও ব্যবহার বেড়ে যাওয়া এবং সে অনুযায়ী টাওয়ার ও তরঙ্গ না থাকা। দেশে ২০১৮ সালের নভেম্বরের পর তেমন কোনো টাওয়ার বসেনি। এ সময়ে বাড়তি তরঙ্গ নেয়নি অপারেটররা।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তরঙ্গ নিলাম হয়েছিল। গ্রামীণফোনের তরঙ্গ আছে ৩৭ মেগাহার্টজ। গ্রাহক প্রায় ৭ কোটি ৯০ লাখ, গত তিন বছরে ১ কোটি ৩১ লাখ বেড়েছে। রবির তরঙ্গ ৩৬ দশমিক ৪ মেগাহার্টজ। তিন বছরে গ্রাহক বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৯ লাখে। বাংলালিংক ও টেলিটকের গ্রাহক সেভাবে বাড়েনি। সোয়া তিন কোটির মতো গ্রাহক নিয়ে বাংলালিংকের হাতে তরঙ্গ আছে ৩০ দশমিক ৬ মেগাহার্টজ।
করোনাকালে মুঠোফোন সেবার মান বাড়াতে রবি, বাংলালিংক ও টেলিটক সরকারের কাছে বিনা মূল্যে সাময়িক সময়ের জন্য কিছু তরঙ্গ বরাদ্দ চেয়েছিল। তাদের দাবি ছিল, বিভিন্ন দেশ করোনা পরিস্থিতিতে চাপ বেড়ে যাওয়ায় তরঙ্গ দিচ্ছে। অপারেটরগুলো সাধারণ মানুষের জন্য ইন্টারনেটের (ব্যান্ডউইডথ) দাম কমিয়েছে। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। সরকারের হাতে ১৮০০ ও ২১০০ ব্যান্ডের ২৭ মেগাহার্টজের বেশি ব্যান্ডউইডথ অলস পড়ে ছিল। এখনো রয়েছে। টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় ও বিটিআরসি অভিযোগ করে, অপারেটরগুলো প্রয়োজন অনুযায়ী তরঙ্গ কেনে না। অপারেটরগুলোর পাল্টা অভিযোগ, বাংলাদেশে তরঙ্গের দাম অত্যন্ত বেশি।
মোবাইল অপারেটর রবি গত বছর দুই অনুষ্ঠানে দুটি উপস্থাপনা তুলে ধরে। এতে দেশে তরঙ্গ পরিস্থিতি ও দাম উঠে আসে। একটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের বিপরীতে গ্রাহক প্রায় ১৩ লাখ। এটা পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, নেপাল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি।
রবির আরেকটি উপস্থাপনায় বলা হয়, বাংলাদেশে গ্রাহকপ্রতি রাজস্বের তুলনায় তরঙ্গের দাম ভারত, থাইল্যান্ড, জার্মানি, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের তুলনায় বেশি। ২০০৮ সালে প্রতি মেগাহার্টজ তরঙ্গের দাম ছিল ১ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা ২০১৮ সালে গড়ে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলারে ওঠে।
তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়ে জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি দুই অপারেটরের চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের দামে বরাদ্দ দেওয়ার চিন্তা করা হয়েছিল। পরে বাংলালিংকও তরঙ্গ চেয়েছে। তাই এখন নিলামের বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা প্রক্রিয়া শেষ করে দ্রুতই নিলাম আয়োজন করার চেষ্টা করছি।’
২০১৮ সালের নভেম্বরে মোবাইল টাওয়ার বসানোর জন্য চারটি কোম্পানিকে লাইসেন্স দেওয়া হয়। ফলে অপারেটরদের কাছ থেকে টাওয়ার বসানোর দায়িত্ব যায় টাওয়ার কোম্পানির কাছে। অবশ্য টাওয়ার কোম্পানির সঙ্গে মোবাইল অপারেটরদের চুক্তির শর্ত নিয়ে বিরোধে ২০১৯ সালে কোনো টাওয়ার বসেনি। বিটিআরসির তথ্য বলছে, ২০২০ সালে মাত্র ২৪১টি টাওয়ার বসেছে। এর মধ্যে গ্রামীণফোন বসিয়েছে ৭টি, রবি ১৭৭টি ও বাংলালিংক ৫৭টি। টেলিটক বসায়নি একটিও।
বিটিআরসি গত নভেম্বরের দিকে টাওয়ার বসানো নিয়ে অপারেটর ও টাওয়ার কোম্পানিকে চাপ দেয়। এরপর টাওয়ার বসানোর প্রক্রিয়া গতি পেয়েছে। এ বিষয়ে টাওয়ার কোম্পানি সামিট টাওয়ারের মূল কোম্পানি সামিট কমিউনিকেশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরিফ আল ইসলাম বলেন, এখন আর জটিলতা নেই। গত নভেম্বরের পর থেকে তাঁরা ১৯০টি টাওয়ার বসিয়েছেন।
অপারেটররা যা বলছে
মুঠোফোন সেবার মান নিম্নগামী কি না এবং তা উন্নত করতে কী করা হচ্ছে—প্রশ্ন করা হয়েছিল শীর্ষ দুই অপারেটর গ্রামীণফোন ও রবিকে। দুটি প্রতিষ্ঠানই সহনীয় মূল্যে তরঙ্গ বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। গ্রামীণফোনের হেড অব এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস মুহাম্মদ হাসান বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে বিদ্যমান ব্যান্ডে তরঙ্গ বরাদ্দের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, ভয়েস কল ও ইন্টারনেট ডেটার মতো প্রথাগত সেবার পাশাপাশি ডিজিটাল অর্থনীতিভিত্তিক সেবায় একটি নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খোলার সুযোগ আছে। তিনি বলেন, অপটিক্যাল ফাইবার নেটওয়ার্কের ক্ষেত্রে বর্তমানে একটি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
‘সেই সেবা এখন রূপকথা’
মুঠোফোন সেবার মান নিয়ে অভিযোগ ও সেবার মান বাড়াতে বাধাগুলো পুরোনো এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানা। ২০১৫ সালে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সেবার মান নিয়ে নিজের ক্ষোভ জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। ২০১৭ সালে তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত একটি অপারেটরের মালিক প্রতিষ্ঠানের প্রধানের কাছে কল ড্রপ নিয়ে উষ্মার কথা জানিয়েছিলেন বলে গণমাধ্যমে খবর আসে। ২০১৮ সালের অক্টোবরে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ কল ড্রপ নিয়ে সংসদে বক্তব্য দেন।
সার্বিক বিষয়ে টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগে যে মানের সেবা পেতাম, সেটা এখন রূপকথার মতো। আসলে সরকার ও অপারেটর জনগণকে ঠকাচ্ছে।’ তিনি বলেন, সরকারের নজর কর আদায়ের দিকে, সেবার মানে তা অনুপস্থিত। বেশি দাম হাঁকিয়ে ৭০ শতাংশ তরঙ্গ অবিক্রীত রাখা বোকামির শামিল।