পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছে টিআইবি
বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার করা যে অর্থ-সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, তা অবিলম্বে জব্দ করে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে টিআই বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ও টিআই-ইউএসের নির্বাহী পরিচালক গ্যারি কালম্যান সম্প্রতি যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেনকে চিঠি দিয়েছেন।
টিআই বাংলাদেশ ও টিআই-ইউএসের প্রধানেরা চিঠিতে পাচার হওয়া অর্থ জরুরি ভিত্তিতে ফেরত আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য দেশের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান। একই সঙ্গে পাচার করা অর্থ দেশে ফেরত আনতে ও অবৈধ অর্থ-সম্পদের মালিকদের জবাবদিহি নিশ্চিতে বাংলাদেশ সরকারকেও সক্রিয় সহযোগিতা করার তাগিদ দেন তাঁরা।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর আগেও বিদেশে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ নিয়ে কথা বলেছে। সর্বশেষ গত ৩০ আগস্ট যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক উন্নয়নবিষয়ক মন্ত্রীকেও চিঠি দিয়েছে টিআইবি ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক চারটি দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা। ওই চিঠিতেও সে দেশে বাংলাদেশিদের অবৈধ সম্পদ ফ্রিজ বা জব্দ করে দেশে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
এ ছাড়া টিআইবি সুইজারল্যান্ড, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) দেশগুলো, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (ইউএই) বিভিন্ন দেশে একই ধরনের চিঠি দিয়েছে।
চিঠিতে যা বলা হয়েছে
যুক্তরাষ্ট্রকে লেখা চিঠিতে বলা হয়েছে, ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উদ্দেশ্যকে আরও এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী ও বড় রপ্তানি গন্তব্য হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে আঞ্চলিক নিরাপত্তা প্রচেষ্টা ও সন্ত্রাস দমনের প্রচেষ্টায় সহায়তা করার জন্য বাংলাদেশের ওপর নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্র।
চিঠিতে বলা হয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশকে আরও উন্মুক্ত ও গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে যুক্তরাষ্ট্র জোরালোভাবে সমর্থন করছে। এ লক্ষ্যে বাণিজ্য প্রণোদনা থেকে শুরু করে দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ বিভিন্ন কৌশল নিয়েছে দেশটি।
সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের বিষয়টি উল্লেখ করে টিআইয়ের চিঠিতে বলা হয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। বিগত সরকারের বৈষম্যমূলক নীতি ও দুর্নীতি ছাত্রদের আন্দোলন জনগণের অভ্যূত্থানে পরিণত হয়েছে। ওই আন্দোলনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নৃশংস ক্র্যাকডাউনে এক হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন।
সাবেক সরকারের কিছু কর্মকর্তা ও তাঁদের সহযোগীদের দ্বারা রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপব্যবহারের বিষয়ে গুরুতর প্রমাণ বের হচ্ছে বলে জানানো হয় টিআইবির চিঠিতে। এতে বলা হয়, এই সম্পদগুলো বাংলাদেশের জনগণের। এ কারণেই যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে দেশটিতে থাকা এ ধরনের যেকোনো সম্পদ শনাক্ত করে বাজেয়াপ্ত করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সাবেক সরকারের মন্ত্রী, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকার, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে বলে জানায় টিআইবি। এসব সম্পদ দ্রুত পুনরুদ্ধারের তাগাদা দিয়ে চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশকে নতুন করে নির্মাণে এবং আরও স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ তৈরিতে এ অর্থ সহায়তা করতে পারে।
এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তিনটি সুপারিশ করেছে টিআইবি ও টিআই-ইউএস। প্রথমত, বাংলাদেশি ব্যক্তি বা কোম্পানি দ্বারা লুট হওয়া কোন ধরনের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে এবং এর মধ্যে কোনগুলো পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, তা তদন্ত করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। একই সঙ্গে এসব সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে বাংলাদেশে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নিতে পারে। এ জন্য প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে দ্রুততম সময়ে অপরাধীদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের আদেশ দেওয়া যায়। পাশাপাশি অপরাধীদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট, অপরাধ তদন্ত বিভাগ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের মতো বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি চুরি হওয়া সম্পদ শনাক্তের জন্য ফরেনসিক পরীক্ষায় সহায়তা এবং আইনজীবী ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করতে পারে তারা।
তৃতীয়ত, আর্থিক নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নিষেধাজ্ঞার মতো লক্ষ্য (ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান) নির্ধারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকার যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ (বিশেষ করে দুবাই) অন্যান্য দেশের সরকারের সঙ্গে কাজ করতে পারে। এতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার, সুশীল সমাজ ও দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা নেওয়া যায়।